হেমন্তের হয়ে ওঠার শুরু | জাহীদ রেজা নূর

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

গত শতাব্দীর আশির দশকের কথা। বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলন হচ্ছে কলকাতার ময়দানে। সম্মেলনের এক সন্ধ্যায় ছিল দুই বন্ধুর আড্ডা। গল্প গান আর কবিতা দিয়ে পূর্ণ ছিল সে আয়োজন। বন্ধু দুজন হচ্ছেন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

আড্ডার মধ্যেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে, ‘তোমার চুল কৃত্রিম রঙে আবৃত কেন?’ অর্থাৎ সুভাষ মুখোপাধ্যায় জানতে চেয়েছিলেন হেমন্ত কেন কলপ লাগান চুলে।

প্রশ্ন শুনে ময়দানে জড়ো হওয়া দর্শক-শ্রোতারা হাততালি দিয়ে উঠলেন। হাসিতে ভরে গেল সারা ময়দান। 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সঙ্গে সঙ্গে সপ্রতিভ স্বরে বললেন, ‘তুমি কবি মানুষ, পাকা চুলের সঙ্গে কবি ইমেজটা খাপ খেয়ে যায়। আমি যদি এক মাথা পাকা চুল নিয়ে প্রেমের গান করি, তাহলে কি শ্রোতারা শুনবে?’

করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে ময়দান। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দেন।

১৯৩৫ সালে বেতারে গাওয়া সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি গান মনে করে তা থেকে দুটো লাইন শুনিয়েছিলেন হেমন্ত। মাঠ ভর্তি দর্শকের কাছে সে ছিল এক অভিনব প্রাপ্তি।

পূজার সময় আকাশবাণী কলকাতায় মহালয়া আমরা সবাই শুনেছি। সেসময় এর সংগীত পরিচালক ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। কোন এক কারণে বেতার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি সে সময় কোন উপস্থিত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে মহালয়ার ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী নামে যে সংগীতালেখ্যটি প্রচারিত হয়েছিল, তার সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্তের বয়স তখন মাত্র ২৪। কতটা প্রতিভাধর হলে এরকম তরুণ বয়সী একজনকে এত বড় একটি কাজের দায়িত্ব দেওয়া যায়! এই কাহিনীটি এখানে বলে রাখলাম, হেমন্তের হয়ে ওঠার পথের গল্পটা বলবো বলে।

ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশন মূলত বড়লোকদের স্কুল ছিল। কেরানি বাবার ছেলে হেমন্ত সেখানে পড়তেন। তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ হলেই কলেজের ঢুকবেন। ক্লাসের মাঝে অফ পিরিওডে হৈচৈ করছিল ক্লাসের ছেলেরা। কোরাস গাইছিল। হঠাৎ সেখানে এসে হাজির হলেন স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। সবাই চুপ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারা গান করছিল?’

এবারও কেউ কথা বলে না।

হেমন্ত সরল মনে বললো, ‘আমি স্যার!’

‘আমার সঙ্গে অফিসে এসো।’

লাল কালি দিয়ে রেজিস্টার খাতা থেকে হেমন্তের নাম কেটে বললেন, ‘যাও এবার গান গেয়ে বেড়াও! স্কুল থেকে তোমায় তাড়িয়ে দেওয়া হল।’

ক্লাসের বন্ধুরা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, একথা শুনে তারা অবাক হলো। ক্লাস এইট দেবকুমার রায় ছিল একটু বেপরোয়া (বড় হয়ে তিনি পুলিশ অফিসার হয়েছিলেন)। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার মশায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘অপরাধ আমরা সবাই করেছি‌ তাহলে আমাদের সবাইকে তাড়ান। শুধু ওকে শাস্তি দিচ্ছেন কেন?’

মাস্টারমশাই হুংকার দিলেন, ‘গেট আউট!’

বড়লোকদের এই স্কুলে ভীষণ গরিব হেমন্ত পড়তেন হাফ ফি দিয়ে। কেরানি বাবা এই কথা শুনলে কতটা আঘাত পাবেন সে কথা ভেবে ভয়ে আর কান্নায় মন শংকিত হয়ে রইল হেমন্তের।

বাবা অফিস থেকে ফেরার পর মায়ের কাছে শুনলেন। কাপড় পরিবর্তন না করেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন কেন নাম কাটা গেল।

মেট্রিক পরীক্ষার তখন মাত্র তিন মাস বাকি। বাবা সেই অবস্থায় গেলেন হেড মাস্টার মশাই এর কাছে। অনুনয় বিনয় করলেন। হেডমাস্টারমশাই সহানুভূতি দেখালেন কিন্তু শাস্তিতো তিনি দেননি দিয়েছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার তাকেই অনুরোধ করতে বললেন।

বাবা সেই রুক্ষ করা মেজাজের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার মশাইয়ের কাছে গিয়ে ছেলের শাস্তি মাফ করার জন্য অনুরোধ করলেন। অবশেষে পাথর গলল।

কথাটা বললাম হেমন্তের মনের জায়গাটা বোঝার জন্য। আর পাঁচজন বাবার মত ছিলেন না হেমন্তের বাবা। এটাই ছিল হেমন্তের জন্য বিস্ময়ের। বাবা যদি একটু বলতেন অথবা মারতেন, তাহলে ও সহ্য হতো। কিন্তু এত অপমান সয়েও তিনি ছেলেকে কিছু বললেন না, বড় হয়ে হেমন্ত সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটা পেয়েছিলেন। অনেকেই হেমন্তের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে, কিন্তু তিনি তা সয়ে গেছেন।

গ্রাম থেকে কলকাতায় দূ রুমের এক বাড়িতে এসে উঠেছিলেন হেমন্তের মা-বাবা। হেমন্তকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুলে। সেখান থেকেই মিত্র ইন্সটিটিউশন। হেমন্তের বাবা ছিলেন জগদীশ নামে একটি ছেলের গৃহশিক্ষক। ‌ চাকরির টাকায় সংসার চলত না বলে ছাত্র পড়াতে হতো তাকে। হেমন্তকেও নিয়ে যেতেন জগদীশের বাড়িতে। একই সঙ্গে দুজনের পড়া হয়ে যেত। তাতে জগদীশের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল হেমন্তের। তাই জগদীশের স্কুল অর্থাৎ মিত্র ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল হেমন্তের। এরপরের ঘটনা তো বলাই হলো‌। যা বলা হল না তা হলো, সেখানেই সহপাঠী হিসেবে অন্যদের মধ্যে হেমন্ত পেয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। যার কথা দিয়ে এই লেখাটি আমরা শুরু করেছিলাম।

কলকাতায় আসার পর কেমন তো দেখলেন যাত্রা গান। মিরাবাই পালা দেখে অভিভূত হলেন। ভাবলেন কি করে এত সুন্দর করে গাইতে পারে কেউ। নিজে নকল করার চেষ্টা করলেন। লক্ষ্য করলেন, কোনো

 গান শুনলেই চুলটা ঠিক চুম্বকের মত তার গলায় চলে আসছে। শ্যামসুন্দর বলে স্কুলের এক বন্ধু ছিল যার বাড়িতে হারমোনিয়াম তবলা গ্রামোফোন রেকর্ড সবই ছিল। হেমন্ত সে বাড়িতে যেতেন মনের খোরাক মেটাতে। নতুন গান শুনলেই শ্যামের বাড়িতে এসে হারমোনিয়াম এসে গান তুলতেন হেমন্ত। সে বাড়ির সবাই তাকে উৎসাহ দিত। ছোটখাটো কোনো অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার ইচ্ছে যাক তো হেমন্তের, কিন্তু কে আর এই গরীব ছেলেটার পাশে এসে দাঁড়াবে?

এসব দেখে খেপে উঠেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। স্কুলের ফাংশনে এত মানুষ গান গায় কেন হেমন্ত চান্স পাবে না?

তখন ওরা ক্লাস নাইনে পড়ে। হেমন্ত কে কেউ পাত্তা দেয় না। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘তোকে আর স্কুলের ফাংশনে গাইতে হবে না‌ ওরা ভালো গায়কদের নিয়ে ফাংশন করুক। তুই চল আমার সঙ্গে রেডিও স্টেশনে। অডিশনের ব্যবস্থা পাকা করে এসেছি।’

সুভাষ মুখোপাধ্যায় সত্যিই এমন তোকে নিয়ে হাজির হলেন অডিশন দেওয়ার জন্য। গানের অডিশন নিয়েছিলেন বিকে নন্দী। হেমন্ত শুনিয়েছিলেন, ‘আজও পড়ে গো মনে’ গানটি। এটি মূলত ছিল সন্তোষ সেনগুপ্তর গাওয়া।

বের হওয়ার পর সুভাষের প্রশ্ন, ‘কিরে কেমন হলো?’

হেমন্ত বললেন, ‘গাইলাম তো দরদ দিয়ে এখন কর্তার মর্জি।’

যেহেতু দরদ দিয়ে গাওয়া হয়েছে, তাই ফল জানার জন্য ডুবন্ত কেউই অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এসেছেন।

পরে অদ্ভুত কান্ড! তিন মাস পরই একটা প্রোগ্রাম পেয়ে গেলেন হেমন্ত। বাবা পছন্দ করতেন না যে ছেলে গান গেয়ে বেড়াবে। শুনে বললেন, ‘রেডিওতে গান গাওয়া হবে না। পড়াশোনা করো মন দিয়ে।’

মুষড়ে পড়া মন নিয়ে সুভাষের বাড়ি গেলেন হেমন্ত। তারা বললেন যে করেই হোক রেডিওতে হেমন্তকে গাইতেই হবে। বাবাকে সবাই মিলে বুঝিয়ে বলবে।

তবে রাতে মা যখন বাবাকে একটু বোঝালেন বাবা রাজি হয়ে গেলেন।

সুভাষকে আনন্দর খবর পৌঁছে দিল হেমন্ত।

কোন গান গাইতে হবে তা ঠিক করা দরকার। কমল দাশগুপ্তের সুরে একটা রেকর্ড বেরিয়েছে যাতে গেয়েছেন যুথিকা রায়। সুরটা মনে ধরেছিল হেমন্তের। হেমন্ত সুভাষকে বললেন, এই সুরে একটি গান লিখে দিতে। গানের প্রথম লাইন ছিল, ‘তোমার হাসিতে জাগে।’

সুভাষ একটু দোদুল্যমান হয়ে বলল, ‘আমি কী গান লিখব! না না সেটা ঠিক হবে না!’

হেমন্ত বললেন, ‘ঠিক হবে না কেন? তুইতো লিখিস। বসে যা লিখতে!’

সারা দুপুর চলল গান লেখার পালা। সুভাষের লেখা গানটি দেখে খুবই খুশি হলেন হেমন্ত। গানটির প্রথম পংক্তি ছিল এরকম,

 ‘আমার গানেতে এলে নবরূপে চিরন্তনী

বাণীময় নীলিমায় শুনি তব চরণধ্বনি।’

দুটো গান করার কথা। আরেকটা গান তবে কোনটা হবে? শচীন দেব বর্মনের অন্ধভক্ত হেমন্ত ঠিক করলেন আরেকটা করবেন ভাটিয়ালি। পাড়ার নিরাপদ চক্রবর্তী ভাটিয়ালি গান করতেন, তাকে ধরায় তিনি গান দিতে রাজি হলেন। 

রেকর্ডিং করার জন্য রেডিও স্টেশনে চললেন হেমন্ত আর সুভাষ, ট্রামে করে। 

গান করলেন। ভয় ডর ছিল না মনে। হেমন্তের একটা বড় ব্যাপার ছিল, তিনি ফলের আশা করতেন না ‌ বলতেন, ‘শুধু মুখ বুঝে কাজ করে যাও, দেখবে ঠিক উতরে গেছ।’

বাড়িতে খুব হাসি খুশি হয়ে ফিরলেন হেমন্ত। অনেকেই বললেন প্রথম গানটা না কি হয়েছে পঙ্কজ মল্লিকের ঢঙে। 

তখন থেকেই কেউ কেউ তাদের বাড়িতে নিয়ে যেত হেমন্তকে। সেই থেকেই রেওয়াজে আর কার্পণ্য করেননি তিনি।

সেসময় গানের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও চলছিল। সুভাষ কবিতা লিখতেন, হেমন্ত লিখতেন গল্প। 

এরই মধ্যে একদিন সুভাষ বলে উঠলেন, ‘সাহিত্য নিয়ে তো খুব মাতামাতি হচ্ছে, কিন্তু গান ছাড়লে চলবে না। রেডিওতে গান হয়েছে এবার রেকর্ডের চেষ্টা করতে হবে।’

হেমন্তকে নিয়ে বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানিতে গেলেন সুভাষ। সেনোলা, পাইওনিয়ার, মেগাফোন, এইচএমভি। কেউ পাত্তা দিল না। রেকর্ড করার ব্যাপারে মনে যে ক্ষীণ আশা ছিল সেটা আর পূরণ হলো না সেসময়। তবে গানের রেওয়াজ চলতেই থাকল। আর চলল সাহিত্য চর্চা। দেশ পত্রিকায় বের হলো গল্প ‘একটি ঘটনা’ নামে। সাহিত্য সভায় নতুন নতুন গল্প লেখা চলতে থাকলো।

ম্যাট্রিক পাশ করে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেন হেমন্ত। সেখানে গানের চর্চা বাড়লো। আর কি অবাক করা কান্ড, একদিন বাবা হেমন্তকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে রেকর্ড করবি?’

বাবার বন্ধু শান্তি বসু হেমন্তকে নিয়ে গেলেন শৈলেশ দত্তগুপ্তর কাছে। 

গান করতে বললেন শৈলেশ। হেমন্ত গাইলেন সন্তোষ সেনগুপ্ত রেকর্ড করা একটি গান যার প্রথম পঙতি ছিল, ‘যদিও দূরে থাকো তবু যে ভুলিনা কো’।

মাঝপথেই হেমন্তকে থামিয়ে দিলেন তিনি। হেমন্ত বুঝলেন, গান পছন্দ হয়নি। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে শৈলেশ বললেন, ‘আজই একটা গান তুলে নাও। কাল আরেকটা শিখিয়ে দেব। ১০ দিনের মধ্যে রেকর্ড করতে হবে।’

নরেশ্বর ভট্টাচার্যের লেখা দুটো গান, ‘বলো গো বলো মোরে’ আর ‘জানিতে যদি গো তুমি।’

১০ দিনের মাথায় সত্যিই বের হলো হেমন্তের প্রথম রেকর্ড।

সেটা ছিল ১৯৩৭ সাল।

এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শুধু এগিয়ে চলা। সে অন্য গল্প।

আরও লেখা

তুষারকন্যা
শিশু ও কিশোর সাহিত্য

তুষারকন্যা

রুশদেশের উপকথাঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ি। ভালোই তো ছিল

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top