আদ্য ‘অ’ এর সূত্র | জাহীদ রেজা নূর

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

বাঙলা স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ হচ্ছে অ। অ–এর আছে দু রকম উচ্চারণ। অ কখনও অ–এর মতো উচ্চারিত হয়, কখনো ও–এর মতো।

দেখা যাক, কীভাবে সেটা মনে রাখা যায়।

শব্দের শুরু, মধ্য ও শেষে অ কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করে সেটা দেখা যাক। অ-এর সূত্র সবক্ষেত্রে একরকম হবে না। অমন সহজ সরল এই বাক্যটিতে তিনটি শব্দ আছে। প্রতিটি শব্দের প্রথম বর্ণ বলার সময় অ-কারান্ত, দ্বিতীয় বর্ণের সময় ও কারান্ত আর তৃতীয় বর্ণ বলার সময় হসন্ত বলা হচ্ছে অমোন্ সহোজ্ সরোল্। কিন্তু বানানের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রত্যেকটি বর্ণ অ-কারান্ত। অ-ম-ন/স-হ-জ/স-র-ল। প্রথম বর্ণ অর্থাৎ আদিতে একরকম নিয়ম, দ্বিতীয় বর্ণ অর্থাৎ মধ্যে অন্য রকম নিয়ম এবং তৃতীয় অর্থাৎ অন্তে আর একরকম নিয়ম। তাহলে তোমরা দেখতে পাচ্ছো, অ-এর সূত্র হবে তিনরকম। আদ্য অ-এর সূত্র, মধ্য অ-এর সূত্র এবং অন্ত অ-এর সূত্র।

আদ্য অ-এর প্রথম সূত্র :

১. অ+ই=ও

সূত্র নয়, প্রথমে কিছু শব্দ বলি। যে শব্দগুলো বলব, সবগুলো শব্দের প্রথমে থাকবে অকার, দ্বিতীয় বর্ণে থাকবে হ্রস্বইকার। দেখা যাক শব্দগুলো:

অই (ওই), সই (সোই), খই (খোই), দই (দোই), হৈ হৈ (হোই হোই), রৈ রৈ (রোই, রোই), কড়ি (কোড়ি), মতি (মোতি), গতি (গোতি), রতি (রোতি), পতি (পোতি), অতি (ওতি), অহি (ওহি), ছবি (ছোবি), রবি (রোবি), পলি (পোলি), অস্থি (ওস্থি), কবিতা (কোবিতা), সবিতা (সোবিতা), কলিকাতা (কোলিকাতা), অধিক (ওধিক), অগ্নি (ওগ্নি), অর্চিত (র্ওচিতো), অছিলা (ওছিলা), জরিমা (জোরিমা), তনিমা (তোনিমা), অভিনয় (ওভিনয়্), অভিজাত (ওভিজাত্) ইত্যাদি।

কী দেখতে পাচ্ছি? অ–কারের পরের বর্ণে ই–কার থাকলে প্রথম অ–কারটি ও–কার হয়ে যায়।

তাহলে সূত্রটা দাঁড়াচ্ছে, শব্দের প্রথমে যদি অ-থাকে (স্বাধীন কিংবা ব্যঞ্জনে যুক্ত), তারপরে ই-কার থাকে, তাহলে আগের অ–কারটি ও–কার হবে।

অ+ই=ও

 ২.

অ+ঈ = ও

নঈ (নোই), নদী (নোদি), সতী (সোতি), গভীর (গোভির), শরীর (শোরির), অতীত (ওতিত্), অধীন্ (ওধিন্), মণীষা (মোনিশা), রসবতী (রসোবোতি), গম্ভীর (গোর্ম্ভি), অভীপ্সা (ওভিপ্সা), অহীন্দ্র (ওহিন্দ্রো), পত্নী (পোত্নি) ইত্যাদি।

ঈ-কারের প্রভাবে প্রথম বর্ণের অ-কারটি ও এর মতো উচ্চারিত হয়

অ+ঈ = ও

৩.

অ+উ = ও

বউ (বোউ), মউ (মোউ), তবু (তোবু), কভু (কোভু), তরু (তোরু), বকুল (বোকুল), কবুল (কোবুল), অধুনা (ওধুনা), অযুত (ওজুত্), মধুর (মোর্ধু), কবুতর (কোবুর্ত), অনুভব (ওনুভব্), অনুমান (ওনুমান্), অনুশীলন (ওনুশিলন্), অনুকম্পা (ওনুকম্পা), অনুকরণ (ওনুকরন্) ইত্যাদি।

অধুনা বকুল গাছে হনুমান অনুশীলন করে। বউয়ের অনুভবে শুধুই কবুল?

অর্থাৎ উ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়।

অ+উ = ও

৪.

অ+ঊ = ও

বধূ (বোধু), ময়ূর (মোয়ুর), কটূক্তি (কোটুক্তি), করুন (কোরুন), মরূদ্যান (মোরুদ্দান), কর্পূর (র্কোর্পু), মসূর (মোশুর), অনূদিত (ওনুদিতো) ইত্যাদি।

(অর্থাৎ ঊ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়।

অ+ঊ = ও

৫.

অ+ঋ-কার = ও

বক্তৃতা (বোক্তৃতা), যকৃত (জোকৃত্), কর্তৃত্ব (কোরতৃত্তো), কর্তৃপক্ষ (কোরতৃপখ্খো), কর্তৃকারক (র্কোতৃকারোক), ভতৃহরি (র্ভোতৃহরি), ভতৃহীনা (র্ভোতৃহিনা), মসৃণ (মোসৃন্) ইত্যাদি।

অর্থাৎ ঋ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়।

অ+ঋ-কার = ও

 অ+ক্ষ-কার = ও

লক্ষ (লোক্খো), কক্ষ (কোক্খো) দক্ষ (দোক্খো), পক্ষ (পোক্খো), রক্ষ (রোক্খো), যক্ষ (যোক্খো), অক্ষাংশ (ওক্খাংশ), অক্ষরেখা (ওক্খোরেখা), লক্ষণ (লোক্খোন), ভক্ষণ (ভোক্খোন), তক্ষক (তোক্খোক) ইত্যাদি।

অর্থাৎ ক্ষ-এর প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়

অ+ক্ষ-কার = ও

৭) অ+য-ফলা = ও

অন্য (ওন্নো), জন্য (জোন্নো), ধন্য (ধোন্নো), গণ্য (গোন্নো), পণ্য (পোননো), নব্য (নোব্বো), সভ্য (শোভ্ভো), সত্য (সোত্তো), বন্য (বোন্নো), বন্যা (বোন্না), কন্যা (কোন্না), কল্যাণ (কোল্ল্যান), গব্যঘৃত (গোব্বোঘৃতো), তথ্য (তোত্থো), পথ্য (পোত্থো), অত্যন্ত (ওত্তোনতো) অধ্যক্ষ (ওদ্ধোক্খো), অত্যাচারিত (ওত্তাচারিতো) ইত্যাদি।

অন্য মানুষের জন্য যা সত্য, তা নব্য সভ্যদের জন্যও একই তথ্য দেয়।

অর্থাৎ য-ফলার প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়

অ+য-ফলা = ও

৮) অ+জ্ঞ = ও

(অর্থাৎ জ্ঞ প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়)যেমন : যজ্ঞ (যোগ্গো)

ব্যতিক্রম১.

আমরা বলছি, অবিকৃত (অবিকৃতো), অবিচার (অবির্চা), অস্থির (অস্থির), অবিরাম  হ্রস্বইকার আছে দি্বতীয় বর্ণে, কিন্তু বলছি অ

 তেমনি, অসীম (অশিম্), অতুল (অতুল্), অনুপস্থিত (অনুপোস্থিত), অমূল্য (অমুল্লো), অদৃষ্ট (অদৃশ্টো), অতৃপ্ত (অতৃপ্তো), অন্যায় (অন্ন্যায়), অব্যয় (অব্বয়), অটুট (অটুট্), অক্ষম (অক্খম্), অক্ষয় (অক্খয়্), অজ্ঞ (অগ্গোঁ), অজ্ঞান (অগ্গ্যাঁন), সঠিক (সঠিক্), সচিত্র (সচিত্ত্রো), সবিনয় (সবিনয়্।

কেন?

কারণটা খুব সোজা। শব্দের প্রথমে যদি না-বোধক বা নেতিবাচক কিংবা অন কিংবা সহিতর্থে থাকে তাহলে কোন অবস্থাতেই সেই কিংবা ও-কারান্ত উচ্চারিত হবে না। এখানে কোন অবস্থাতেই বলতে বোঝানো হচ্ছে, অ, অন, কিংবা স এর পর ই-কার, উ-কার, ক্ষ, জ্ঞ যাই আসুক না কেন অবিকৃত থাকবে

ব্যতিক্রম

যেখানে কারো নাম বোঝায় সেখানে না-বোধক কোথাও কোথাও ও-কারান্ত হতে পারে। যেমন ওতুল প্রসাদের গান বলা হয় কেন? এখানে অতুলের স্থলে ওতুল বলা হচ্ছে যেহেতু ওটি একটি নাম। আমাদের দেশের সঙ্গীত শিল্পী ওজিত রায় (অজিত) কিংবা কবি ওসীম (অসীম) সাহা। ওবিনাশ (অবিনাশ) দত্ত কিংবা ওনুপম (অনুপম) সেন। তবে নামের ক্ষেত্রে অ-যদিও ও-এর দিকে ঝুঁকে যায়, তবু অ-কারান্ত হলে ভালো হয়, তাতে নামের দিক থেকে অর্থগত অসুবিধা হয় না।

অতুল প্রসাদ আর অজিত রায়ের কণ্ঠে গান ভালো লাগে।

ব্যতিক্রম-৩

রোগের লক্ষণ (লোক্খোন্) কিন্তু ক্ষ তে যদি ম-ফলা থাকে, তবে আগের ‘অ’ কোথাও অ-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন রামের ভাই লক্ষ্মণ (লক্খোঁন) একইভাবে পক্ষ্ম (পক্খোঁ), যক্ষ্মা (যক্খাঁ)।

 আদ্য অ-এর দ্বিতীয় সূত্র

প্রথম (প্রোথোম্), প্রভাত (প্রোভাত্), ব্রত (ব্রোতো), শ্রম (শ্রোম্), ভ্রমণ (ভ্রোমোন্), ভ্রমর (ভ্রোর্মো), দ্রষ্টা (দ্রোষ্টা), স্রষ্টা (স্রোষ্টা)।

ব্যতিক্রম : র-ফলা যুক্ত বর্ণটির পরে যদি ‘য়’ আসে, তাহলে কিন্তু অ-কার ঠিক থাকে। যেমন : ক্রয় (ক্রয়), ত্রয় (ত্রয়), আশ্রয় (আস্স্রয়)।

 শব্দের প্রথমে যদি অ-কারান্ত বর্ণে র-ফলা যুক্ত হয়, তাহলে সাধারণত ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়।

আদ্য অ-এর তৃতীয় সূত্র

কলিকাতা থেকে কলকাতা (কোলকাতা) হরিতকি থেকে হরতকি (হোরতোকি) সজিনা থেকে সজনে (সোজনে) ফড়িয়া থেকে ফড়ে (ফোড়ে) বাড়িয়া থেকে বড়ে (বোড়ে) ধরিয়া থেকে ধরে (ধোরে) মরিয়া থেকে মরে (মোরে) সরিয়া থেকে সরে (সোরে) ধসিয়া থেকে ধসে (ধোসে)

পচিয়া থেকে পচে (পোচে) গলিয়া থেকে গলে (গোলে) পড়িয়া থেকে পড়ে (পোড়ে)

সব জায়গাতে এই নিয়ম খাটবে না। এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন :

রইবে থেকে রোবে নয়, রবে লইবে থেকে লোবে নয়, লবে সইবে থেকে সোবে নয়, সবে বইবে থেকে বোবে নয়, ববে কইবে থেকে কোবে নয়, কবে হইবে থেকে হোবে নয়, হবে।

সাধুভাষার পূর্ণাঙ্গ শব্দে কিংবা ক্রিয়াপদে ই-কার কিংবা উ-কার ছিল, চলিত ভাষার সংক্ষিপ্ত রূপে সেই ই-কার কিংবা উ-কার বিলুপ্ত হলেও তার আগের অ-কার প্রমিত উচ্চারণে ও-কারান্ত হয়ে থাকে।

আদ্য অ-এর চতুর্থ সূত্র

মূল বানান বর্তমান বানান উচ্চারণ

পর্য্যন্ত পর্যন্ত পোরজোনতো পর্য্যায় পর্যায় পোরজায় পর্য্যটন পর্যটন পোরজোটোন পর্য্যালোচনা পর্যালোচনা পোরজালোচনা পর্য্যবেক্ষণ পর্যবেক্ষণ পোরজোবেক্খোন মর্য্যাদা মর্যাদা মোরজাদা চর্য্যাপদ চর্যাপদ চোরজাপদ

১৯৩৬ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির এক নম্বর নিয়মে বলা হলো, রেফ এর পর ব্যঞ্জনে কোন দ্বিত্ব হবে না। সুতরাং য-রেফ এর পর য-ফলা উঠে গেল। যেমন :

পর্য্যন্ত হয়ে গেল পর্যন্ত সূর্য্য হয়ে গেল সূর্য

বানান সংস্কার করা হলেও, উচ্চারণে কোন পরিবর্তন আনা হলো না। ফলে পূর্বের উচ্চারণটি অবিকৃত থেকেই গেল।

আদ্য অ-এর পঞ্চম সূত্র :

একাক্ষর বা এক অক্ষর বিশিষ্ট শব্দের শেষে যদি ‘ন’ থাকে, তাহলে সাধারণত পূর্বের অ-এর উচ্চারণ ও-কারান্ত হয়।

যেমন: মন (মোন), বন (বোন), জন (জোন) তবে বাংলাদেশে ধন উচ্চারণের ক্ষেত্রে ধোন্ না বলে ধন্ (অ-অবিকৃত) বলা হয় এবং জন এর ক্ষেত্রেও জোন না বলে জন্ (অ-অবিকৃত) বলা হয়ে থাকে।

আবার যদি একাক্ষর শব্দের শেষে ন-এর পরিবর্তে ণ থাকে, তাহলে পূর্বের অ-টিকে অবিকৃত রেখে অ-কারান্ত উচ্চারণ করা হয়। যেমন- পণ, মণ, রণ, ক্ষণ ইত্যাদি।

একাক্ষরবিশিষ্ট শব্দগুলি যখন অন্য শব্দের সঙ্গে সন্ধির সূত্রে আবদ্ধ হয় কিংবা অন্য পদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমাসবদ্ধ হয়, তখন কিন্তু তার আসল উচ্চারণ অর্থাৎ অ-কারান্ত উচ্চারণের রূপেই ফিরে আসে।

যেমন-

মনান্তর-মনান্তর মনোহর-মনোহর মনোলোভা-মনোলোভা মনোতোষিনী-মনোতোষিনি

মধ্য

এখানে বলে দেওয়া ভালো, যে কারণে শব্দের আদ্য-অ, ও-কারন্ত উচ্চারিত হয়, তার সবগুলি সূত্রই মধ্য-অ এর ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন- ই-কার আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে মতি (মোতি) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে সুমতি (সুমোতি) দুর্মতি (র্দুমোতি) অগতি (অগোতি) প্রগতি (প্রোগোতি) কুমতি (কুমোতি) 

 উ-কার/ঊ-কার/ঋ-কার আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে তনু (তোনু) ময়ুর (মোয়ুর) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে সুতনু (সুতোনু) সুমধু (সুমোধু) পথতরু (পথোতোরু) পুত্রবধু (পুত্ত্রোবোধু) সুমসৃন (সুমোস্সৃন) অমসৃন (অমোস্সৃন)

ঈ-কার আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে ননী (নোনি) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে জননী (জনোনি) ধরনী (ধরোনি) সরণী (সরোনি) বরনী (বরোনি) ঘরনী (ঘরোনি)  য-ফলা বিলুপ্ত আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে পর্যায় (র্পোযায়) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে আশ্চর্য (আশ্চোরযো) ঐশ্বর্য (ঐর্শোযো) সৌন্দর্য (সৌর্ন্দোযো)

আদ্য-অ-এর সূত্র অনুযায়ী মধ্য-অ তেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হলে আলাদাভাবে আলোচনা করার আর দরকার কি? বললেই হতো, আদ্য, মধ্য এবং অন্ত সকল অ-এর ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য। আলাদা আর কোন সূত্র নেই। কে বলেছে, মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে কোন মৌলিক সূত্র নেই?

মধ্য-অ-এর মৌলিক সূত্র:

তিনবর্ণে গঠিত শব্দের প্রথম বর্ণটি যদি অ-কারান্ত, আ-কারান্ত, এ-কারান্ত কিংবা ও-কারান্ত হয়, তাহলে মাঝখানের অ-কারান্ত বর্ণটি সাধারণত ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, শর্ত চারটি হলো : অ-কারান্ত, আ-কারান্ত, এ-কারান্ত, ও-কারান্ত। 

আদ্য বর্ণ অ-কারান্ত অমন (অমোন্) গঠন (গঠোন্) যখন (যখোন্) তখন (তখোন্) পঠন (পঠোন্) ফসল (ফসোল্) ফলন (ফলোন্) কলম (কলোম্) মশক (মশোক্) দলন (দলোন্) মলন (মলোন্) শতক (শতোক্) যতন (যতোন্) রতন (রতোন্) 

আদ্য বর্ণ আ-কারান্ত আমন (আমোন্) কাজল (কাজোল্) আসল (আসোল্) কাগজ (কাগোজ্) পাগল (পাগোল্) ছাগল (ছাগোল্) জাগর (জার্গো) নাগর (নার্গো) সাগর (সার্গো) আসন (আসোন্) বাসন (বাসোন্)

কাজল চোখে আসল মানুষ, পাগল ছাগল নেই। সাগর জলে বাসন মাজে কে? 

আদ্য বর্ণ এ-কারান্ত  চেতন (চেতোন্) বেতন (বেতোন্) কেতন (কেতোন্) লেহন (লেহোন্) শেখর (শের্খ) কেশর (কের্শো)

আদ্য বর্ণ ও-কারান্ত  ওজন (ওজোন্) ভোজন (ভোজোন্) শোধন (শোধোন্) বোধন (বোধোন্)

তোষণ (তোষোন্) লোচন (লোচোন্) রোচন (রোচোন্) 

ব্যতিক্রম

তিনবর্ণে গঠিত শব্দের প্রথম বর্ণটি যদি না বোধক অ-হয়, কিংবা সহিত অর্থে স-হয়, তাহলে মাঝখানের অ-কারান্ত বর্ণটি ও-কারান্ত উচ্চারিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যেমন : অচল (অচল্) অজর (অর্জ) অমর (অর্ম) অমল (অমল্) অবশ (অবশ্) অবলা (অবলা) সরস্ (সরস্) সরব (সরব্) সফল (সফল্) সজল (সজল্) অটল (অটল্) অচল (অচল্) 

মধ্য -অ-এর দ্বিতীয় ও শেষ সূত্র

একাধিক সংস্কৃত শব্দ বা তৎসম শব্দ সমাসবদ্ধ পদে পরিণত হলে, পূর্বপদের শেষের অ-কারান্ত বর্ণটি ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন : পথ (পথ্) থেকে পথচারী (পথোচারি) মেঘ (মেঘ্) থেকে মেঘমালা (মেঘোমালা) জল (জল্) থেকে জলচর (জলোচর) শ্রম (শ্রম্) থেকে শ্রমমন্ত্রী (শ্রমোমোন্ত্রি) বন (বন্) থেকে বনভূমি (বনোভুমি), বনচারী (বনোচারি), বনবাসী (বনোবাসি) লোক (লোক্) থেকে লোকসাহিত্য (লোকোসাহিত্ত্য)  গণ (গণ্) থেকে গণব্যবহার (গনোব্যবহার), গণনাট্য (গনোনাট্ট্য), গণনায়ক (গনোনায়ক্) 

এবারো কিন্তু ব্যতিক্রম আছে। যেমন : রাজ (রাজ্) থেকে রাজহংস (রাজহংসো), রাজহাঁস (রাজহাঁস), রাজকন্যা (রাজকননা), রাম (রাম্) থেকে রামচন্দ্র (রামচন্দ্রো)

অন্ত্য এর সূত্র 

 প্রথম সূত্র :

যুক্ত – যুক্ + তো – যুক্তো,  শক্ত – শক্ + তো – শক্তো.  ভক্ত – ভক্ + তো – ভক্তো, রক্ত – রক্ + তো – রক্তো. যত্র – যত + ত্রো – যত্ত্রো

তত্র – তত্ + ত্রো – তত্ত্রো পত্র – পত্ + ত্রো – পত্ত্রো মাত্র – মাত্ + ত্রো – মাত্ত্রো 

শব্দের শেষে যদি অ-কারান্ত যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে তা হলে তার প্রথমটি হসন্ত এবং দ্বিতীয়টি সাধারণত: ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়।যেমন-

দ্বিতীয় সূত্র : ত কিংবা ইত প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দে অন্তিম-অ রক্ষিত এবং ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়ে থাকে। যেমন :

নত – নতো,  গত – গতো, মত – মতো, যত – যতো, তত – ততো. শতশত – শতোশতো, গঠিত – গোঠিতো, রক্ষিত – রোক্খিতো, পালিত – পালিতো, দিক্ষিত – দিক্খিতো, মোহিত – মোহিতো

যে সকল শব্দ বিশেষ্য রূপে ব্যবহৃত হয়, সে সকল শব্দে সাধারণত হসন্ত উচ্চারিত হয়। তাছাড়া মানুষের মুখের ভাষার ব্যবহারে কতকগুলো শব্দের উচ্চারণ বদল হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় :

হাত – হাত্, ভাত – ভাত্, অতীত – ওতিত্, উচিত – উচিত্

মোহিত উচ্চারণ মোহিতো হবে। কিন্তু আমরা তো কবি মোহিত লাল মজুমদারকে কখনো মোহিতো লাল মজুমদার বলি না। নাম বা পদবী হলে সাধারণত অন্তিম-অ টি হসন্ত উচ্চারিত হয়। যেমন :

রনজিত রক্ষিত – রোক্খিত্, মাধুরী দিক্ষিত – দিক্খিত্, আনন্দচন্দ্র পালিত – পালিত্, লোলিত মোহন নাথ – লোলিত্, মোহিত লাল মজুমদার – মোহিত্,

সূত্রমতে আমরা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত কে নিশ্চিতোই বলবো। কিন্তু এখন অনেকেই নিশ্চিত্ বলছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। হয়তো এমন একদিন আসবে, যখন মুখের ভাষার গতিময়তো নিশ্চিতো কে নিশ্চিত্, স্থগিতো কে স্থগিত্ করে ফেলবে। তখন আমাদের মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।

তৃতীয় সূত্র

বাঙলা ভাষাতে এমন কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলি বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হওয়ার সময় হসন্ত উচ্চারিত হয়, কিন্তু বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হওয়ার সময় ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়।

বিশেষ্য

ভাল (কপাল) – ভাল্, কাল (সময়) – কাল্,

বিশেষণ

ভাল (উত্তম) – ভালো, কাল (রঙ) – কালো

চতুর্থ সূত্র

 বিশেষ্যবাচক শব্দের শেষে ‘হ’ এবং বিশেষণবাচক শব্দের শেষে ‘ঢ়’ থাকলে সাধারণত ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন :

বিবাহ – বিবাহো গাঢ় (গাঢ়ো), কলহ – কলোহো দৃঢ় (দৃঢ়ো), বিরহ -বিরহো মূঢ় (মুঢ়ো), গ্রহ – গ্রোহো প্রগাঢ় (প্রোগাঢ়ো), স্নেহ – স্নেহো দেহ – দেহো

পঞ্চম সূত্র : বাঙলা ভাষার যে সকল শব্দের বানানে বিসর্গ ছিল, কিন্তু বর্তমান বানানে বিসর্গ বিলুপ্ত হয়েছে, সেসকল শব্দের উচ্চারণ সাধারণত ও-কারান্ত হয়। যেমন :- প্রথমত – প্রোথমত (প্রোথোমতো) বস্তুত – বস্তুত (বোস্তুতো) দ্বিতীয়ত – দ্বিতীয়ত (দিতিয়তো) সতত -সতত (সততো) প্রণত – প্রণত (প্রনতো) প্রায়শ – প্রায়শ (প্রায়শো)

ষষ্ঠ সূত্র : বাঙলা ভাষায় ‘তর’ এবং ‘তম’ প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দে শেষের ‘অ’ সাধারণত রক্ষিত থাকে এবং ও-কার উচ্চারিত হয়। যেমন :

উচ্চতর – উচ্চোতরো উচ্চতম – উচ্চোতমো অধিকতর – অধিকোতরো গভীরতর – গভিরোতরো বৃহত্তম – বৃহত্তমো ক্ষুদ্রতর – ক্ষুদ্দ্রতরো

ক্ষুদ্রতম – ক্ষুদ্দ্রতমো

উত্তম-এর উচ্চারণ হবে উত্তম্।

সপ্তম সূত্র : ঙ, ং, ঋ-কার, ঐ-কার, ঔ-কার এর পরে অ-কারান্ত বর্ণ থাকলে সাধারণত শেষের বর্ণটি ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন-

ঙ :

অঙ্ক – অঙ্কো বঙ্ক – বঙ্কো শঙ্খ – শঙ্খো ং : অংশ – অংশো বংশ – বংশো ধ্বংশ – ধ্বংশো কংশ – কংশো ঋ-কার : কৃশ – কৃশো বৃষ – বৃশো তৃণ – তৃনো নৃপ – নৃপো মৃগ – মৃগো

 ঐ-কার :

দৈব – দোইবো শৈব – শোইবো স্ত্রৈণ – স্ত্রোইনো জৈন – জোইনো কৈল – কোইলো হৈল – হোইলো তৈল – তোইলো

ঔ-কার :

গৌণ – গোও্নো মৌন – মোও্নো ধৌত – ধোও্তো ভৌত – ভোও্তো ভৌম – ভোও্মো পৌর – পোওরো সৌর – সোওরো গৌর – গোওরো

ব্যতিক্রমতো অবশ্যই আছে। যেমন :

খৈল – খইল্ দৌড় – দোউড়্ পৌষ – পোউষ্ গৌড় – গোউড়্

এ কোথায় অ্যা এর সূত্র

এ কোথায় অ্যা

বাঙলা স্বরবর্ণে ‘এ’ নামে একটিমাত্র স্বরবর্ণ আছে। কিন্তু তার দুটি উচ্চারিত রূপ আছে। কোথাও ‘এ’ বর্ণটি ‘এ’-এর মতোই অবিকৃত উচ্চারণ হয়। কিন্তু কোথাও কোথাও ‘অ্যা’-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : এক (অ্যাক) কিন্তু একটি (এক্টি)। এজন্য ‘এ’ এর উচ্চারণের ব্যাপারে প্রায়শই বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ‘অ্যা’ আমাদের উচ্চারণে আছে, বচনে আছে, কথায় আছে, কিন্তু লেখায় নেই। তাই সমস্যা থাকবেই, তবে ‘এ’-এর উচ্চারণের বিষয়ে পাকাপোক্ত কোন বিধি বা নিয়ম আমাদের জানা নেই। কিন্তু বোঝার সুবিধার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু সাধারণ সূত্র বা নিয়ম আমরা দাঁড় করাতে পারি।

সূত্র এক : এ-কারের পরে যদি ই-কার, উ-কার কিংবা এ-কার থাকে, তাহলে সাধারণত পূর্বের এ-কার বিকৃত হয় না বা অ্যা-কার রূপে উচ্চারিত হয় না। যেমন

খেলা (খ্যালা) কিন্তু খেলি (খেলি),  বেলা (ব্যালা) কিন্তু বেলি (বেলি), ঠেলা (ঠ্যালা) কিন্তু ঠেলি (ঠেলি), দেখ (দ্যাখ) কিন্তু দেখি (দেখি)

দেখা (দ্যাখা) কিন্তু দেখুন (দেখুন), এক (অ্যাক্) কিন্তু একটি (এক্টি), একটা (অ্যাক্টা) কিন্তু একটু (একটু), টেংরা (ট্যাংরা) কিন্তু টেংরি (টেংরি)

লেংড়া (ল্যাংড়া) কিন্তু লেংড়ি (লেংড়ি), ভেংচানো (ভ্যাংচানো) কিন্তু ভেংচি (ভেংচি), গেছে (গ্যাছে) কিন্তু গেছি (গেছি)

এ-কারের পরে এ-কার দিয়ে উদাহরণ

এ যে মেয়ে সেজে এসেছে।

এ-কার অ্যা-কার

সকাল বেলায় (ব্যালায়) খেয়ে এসেছি টেংরা (ট্যাংরা) মাছের ঝোল।

সূত্র দুই : ধাতু (ক্রিয়ার মূল) কিংবা প্রতিপাদিকে (শব্দের মূল) ই-কার কিংবা ঋ-কার ছিল, পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে সেই ই-কার কিংবা ঋ-কার একবার এ-কার পরিণত হলে, আর কখনো কোন অবস্থাতেই সেই এ-কার অ্যা-কারান্ত উচ্চারিত হবে না।

যেমন :

কিন্ থেকে কেনা কিন্তু ক্যানা নয়, মিল্ থেকে মেলা কিন্তু ম্যালা নয়, লিখ্ থেকে লেখা কিন্তু ল্যাখা নয়, গিল্ থেকে গেলা কিন্তু গ্যালা নয়

মিশ্ থেকে মেশা কিন্তু ম্যাশা নয়, জিলা থেকে জেলা কিন্তু জ্যালা নয়, শিখ্ থেকে শিখা কিন্তু শ্যাখা নয়, মিষ্ থেকে মেষ কিন্তু ম্যাষ নয়

পিট্ থেকে পেটা কিন্তু প্যাটা নয়, রিচ্ থেকে রেচক্ কিন্তু র‌্যাচক নয়, লিহ্ থেকে লেহন্ কিন্তু ল্যাহন্ নয়, বিদ্ থেকে বেদ্ কিন্তু ব্যাদ নয়

নী থেকে নেতা কিন্তু ন্যাতা নয়, দিশ্ থেকে দেশ্ কিন্তু দ্যাশ নয়, মিদ্ থেকে মেদ্ কিন্তু ম্যাদ নয়, চিল্ থেকে চিল্লানো কিন্তু চ্যাল্লনো নয়

মিরাজ্ থেকে মেরাজ্ কিন্তু ম্যারাজ্ নয়, কিতাব্ থেকে কেতাব্ কিন্তু ক্যাতাব নয়, সিতার থেকে সেতার কিন্তু স্যাতার নয়, বিতার থেকে বেতার কিন্তু ব্যাতার নয়, মিজাজ্ থেকে মেজাজ্ কিন্তু ম্যাজাজ্ নয়, বিয়াদব্ থেকে বেয়াদব্ কিন্তু ব্যায়াদব নয়

সূত্র তিন : সংস্কৃত থেকে আসা শব্দ অর্থাৎ তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ শব্দে এ-কারান্ত থাকে। কারণ সংস্কৃতে অ্যা নামক কোন ধ্বনি নেই।

যেমন

প্রেম্ কিন্তু প্র্যাম নয়, বেদ্ কিন্তু ব্যাদ নয়, মেদ্ কিন্তু ম্যাদ নয়, রেবা কিন্তু র‌্যাবা নয়, বেত্র (বেত্ত্রো) কিন্তু ব্যাত্ত্র    নয়, মেধা কিন্তু ম্যাধা নয়, সেতু কিন্তু স্যাতু নয়, মেরু কিন্তু ম্যারু নয়, ধেনু কিন্তু ধ্যানু নয়, কেয়ূর কিন্তু ক্যায়ুর নয়, প্রেরক কিন্তু প্র্যারক নয়, তেজ কিন্তু ত্যাজ নয়, হেমন্ত (হেমন্তো) কিন্তু হ্যামন্তো নয়, বেগ্ কিন্তু ব্যাগ নয়, পেচক্ কিন্তু প্যাচক নয়, বেতস্ কিন্তু ব্যাতস নয়, কেতন্ কিন্তু ক্যাতন নয়, কেদার কিন্তু ক্যাদার নয়, চেতনা (চেতোনা) কিন্তু চ্যাতনা নয়, তেজস্বী (তেজোশ্শি) কিন্তু ত্যাজস্বী নয়, দেবকী (দেবোকী) কিন্তু দ্যাবকী নয়, দেবর্ষি (দেবোরসী) কিন্তু দ্যাবরসি নয়, বেনী (বেনী) কিন্তু ব্যানী নয় মেদিনী (মেদিনী) কিন্তু ম্যাদিনী নয়, মেনকা (মেনোকা) কিন্তু ম্যানকা নয়

শ, স ও ষ এর সূত্র

বাঙলায় তিনটি শ আছে। তালব্য, মুর্ধণ্য এবং দন্ত্য। তিনটি শ এর রূপ আলাদা হলেও বাঙলা ভাষায় একটিই শ (Sh) উচ্চারিত হয় প্রধানত মূলধ্বনি হিসেবে। তবে কোথাও কোথাও শ (Sh) কিন্তু স (S) এর মতো উচ্চারিত হয়।

সেটা কোথায় হয়? যখন শ সহধ্বনি হয়ে যায় অর্থাৎ অন্যধ্বনির প্রভাবে সেই শ টা স এর মতো হয়ে যায়। ত, থ, ন, র, ল এইসব দন্ত্য বা দন্ত্যমূলীয় বর্ণের সঙ্গে স বা শ যখন সংযুক্ত অবস্থায় উচ্চারিত হয়, তখন তার উচ্চারণ হয়ে যায় রীতিমতো স (S) এর মতো। যেমন :

মস্ত – মস্তো সমস্ত – শোমোস্তো দরখাস্ত – দরখাস্তো বরখাস্ত – বরখাস্তো প্রস্তুতি – প্রোস্তুতি ব্যস্ত – ব্যাস্তো গ্রস্ত – গ্রোস্তো মস্তক – মস্তোক

বস্তি – বোস্তি আস্তে – আস্তে রাস্তা – রাস্তা খাস্তা – খাস্তা নাস্তা – নাস্তা কাস্তে – কাস্তে দস্তা – দসতা কুস্তি – কুস্তি দোস্তি – দোস্তি বন্দোবস্ত – বন্দোবস্তো ধস্তাধস্তি – ধস্তাধোস্তি খিস্তি – খিস্তি সুস্থ – শুস্থো  আস্থা – আস্থা স্থিতি – স্থিতি উপস্থিত – উপোস্থিত্ অস্থাবর – অস্থাবর

মুখস্ত – মুখোস্তো ব্যবস্থা – ব্যবোস্থা স্থান – স্থান স্নান – স্নান (Snan) স্নেহ – স্নেহো (Sneho) স্নিগ্ধ – স্নিগ্ধ (Snigdho) স্নায়োবিক – স্নায়োবিক (Snayobic) অশ্লীল – অস্লীল শ্লেষ – স্লেস (Slesh) শ্লোক – স্লোক (Sloke) শ্রোতা – স্রোতা (Srota) শ্রবণ – স্রবন (Srobon) শৃগাল – সৃগাল

শ্রাবণ – স্রাবোন (Srabon) শ্রীলঙ্কা – স্রীলংকা (Sreelonka) শ্রীমান – স্রীমান (Sreeman) প্রশ্ন – প্রোস্নো শ্রদ্ধা – স্রোদ্ধা (Sroddha) শ্রেয়সী – স্রেয়োশি (Sreyoshi) বিশ্রী – বিস্স্রি শ্রেষ্ঠ – স্রেশ্ঠো (Sreshtho) সংশ্লিষ্ঠ – শঙস্লিশ্টো (Shongslishto) শ্লাঘা – স্লাঘা (Slagha) শ্লথগতি – স্লথোগোতি (Slothogoti)

ঞ এর সাথে জ যুক্ত হয়ে ঞ্জ যুক্তধ্বনি তৈরী হয়। এতে ঞ এর উচ্চারণ ন এর মতো হয়, কিন্তু জ এর উচ্চারণ অবিকৃত থাকে। যেমন :

ভঞ্জ – ভন্জো রঞ্জ – রন্জো গঞ্জিত – গোন্জিতো ব্যঞ্জন – ব্যান্জোন্ খঞ্জনা – খন্জোনা অঞ্জনা – অন্জোনা

জ এর সাথে ঞ যুক্ত হয়ে জ্ঞ যুক্তধ্বনি তৈরী হয়। শব্দের আদিতে জ্ঞ এর উচ্চারণ সাধারণত গঁ বা গ্যঁ এর মতো এবং শব্দের মধ্যে ও অন্তে গ্গঁ এর মতো হয়। যেমন :

জ্ঞাত – গ্যাঁতো, জ্ঞান – গ্যাঁন, জ্ঞাপক – গ্যাঁপোক্, জ্ঞেয় – গেঁয়ো, বিজ্ঞান – বিগ্গ্যাঁন, বিজ্ঞপ্তি – বিগগোঁপ্তি, অজ্ঞান – অগ্গ্যাঁন, অবজ্ঞা – অবোগ্গাঁ

অজ্ঞ – অগ্গোঁ., বিজ্ঞ – বিগ্গোঁ, দৈবজ্ঞ – দোইবোগ্গোঁ, বিশেষজ্ঞ – বিশেশোগ্গোঁ,

চ, ছ, ঝ এই বর্ণগুলিও ঞ এর সাথে যুক্ত হয় এবং জ্ঞ এর মতোই ঞ এর উচ্চারণ ন এর মতো হয়। যেমন-

পঞ্চ – পন্চো, মঞ্চ – মন্চো, লাঞ্ছিত – লান্ছিতো, ঝঞ্ঝা – ঝন্ঝা, ঝঞ্ঝনা – ঝন্ঝোনা, কাঞ্চন – কান্চোন

শুদ্ধ উচ্চারণ

বাংলা ভাষা উচ্চারণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রমিত উচ্চারণের ক্ষেত্রে সমস্যার জন্য আমি তোমাদের মূল পাঁচটি কারণের ব্যাখ্যা দিতে চাই। এই কারণগুলি হলো :

১) বাঙলা ভাষার লিখিতরূপের সঙ্গে বহুক্ষেত্রে তার উচ্চারিত রূপ একই হয় না।

২) বাঙলা ভাষার বর্ণ আছে একাধিক, কিন্তু তার ধ্বনি প্রতীক এক। আবার বর্ণ আছে একটি, কিন্তু তার ধ্বনি একাধিক।

৩) আমাদের উচ্চারণে প্রায়শ মহাপ্রাণ বর্ণগুলো অল্পপ্রাণ হয়ে যায়।

৪) আমাদের আঞ্চলিকতার সমস্যা।

৫) বাঙলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদ ও আন্তরিকতার অভাব।

এজন্য আমাদের অবহেলা ও অযত্ন দায়ী।

সমস্যা নম্বর এক : আমাদের ভাষার লিখিত রূপ আর উচ্চারিত রূপ সর্বত্র এক নয়। কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বানান পদ্ধতি মূলতঃ সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত এবং উচ্চারণ পদ্ধতি প্রাকৃত প্রভাবিত। আমরা লিখি সংস্কৃত ভাষায়, কিন্তু সেটা পড়ি প্রাকৃত বাঙলায়। অর্থাৎ আমাদের বানান পদ্ধতি আর উচ্চারণ পদ্ধতি এক নয়। যেমন আমরা বলি আমি আত্মীয় (আত্তীঁয়) বাড়ীতে যাব, এখন এই যে আত্মীয়, এখানে ম-ফলা আছে, যদি লেখা অনুসারে পড়তে হয়, তাহলে বলতে হয় আত্মীয় বাড়ীতে যাব, না গেলে ভসমো হয়ে যায়। আসলে ভস্ম (ভস্ সো)

যেমন লেখা হচ্ছে বিশ্ব, বানান অনুসারে পড়তে গেলে বলতে হয় বিশবো। কিন্তু উচ্চারণ করা হচ্ছে বিশশো। বিদ্বান এবং উদ্যানের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে বিদ্দান এবং উদ্দান, কিন্তু বানান অনুযায়ী যদি উচ্চারণ করা হতো তাহলে বলতে হতো বিদ্বান এবং উদ্দ্যান। সংস্কৃত লিখিতরূপে আলাদা ছিল এবং উচ্চারণও ছিল ভিন্ন। কিন্তু বাঙলাতে ঐ বানানটি নেওয়া হলো, কিন্তু উচ্চারণটি পৃথক হয়ে গেল। 

সমস্যা নম্বর দুই : বাঙলা বর্ণমালায় একাধিক বর্ণের ধ্বনিগত উচ্চারণ এক। যেমন দুটো ন আছে বাংলায় একটি হলো মুর্ধন্য-ণ আর একটি দন্ত্য-ন। কিন্তু এই দুটো ন কে আমরা ভিন্নরকম উচ্চারণ করি না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে জনগণ।

জ আছে দুটো। একটি বর্গীয় জ এবং আর একটি হলো অস্তস্থ য। কিন্তু জামাই এবং যম শব্দ দুটোতে দুরকম য থাকলেও উচ্চারণে কোন ভিন্নতা পাওয়া যায় না।

একটি নয়, দুটি নয়, তিনটি স। একটাকে বলে তালব্য, একটাকে বলে মূর্ধন্য আর একটাকে বলে দন্ত্য। এই যে তিনটি শ, এই তিনটি স-ই কিন্তু বাঙলা ভাষাতে আমাদের উচ্চারণে এক হয়ে যায়। কারণ আমরা শেষে কিন্তু বলি তালব্য-স, মূর্ধন্য-স, দন্ত্য-স অর্থাৎ স, ষ এবং শ। তিনটি স-এর চেহারা আলাদা উচ্চারণ এক। সবিশেষ লিখতে তিনটি স-ই ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু উচ্চারণে তিনটি স-এর কোন ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায় না।

স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ-অ। এটা কোথাও ‘অ’-এর মতো উচ্চারিত হয়। আবার কোথাও ‘ও’-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন অত (অ অবিকৃত) ভাবার দরকার নেই, অতি (অ-ও এর মতো) বাড় বেড়ো না। আমি কব (অ-অবিকৃত) না কথা, আমি কবি (অ ও এর মতো) না। আবার নটবর এবং নই শব্দ দুটোতে দেখা যাচ্ছে নটবর এর অ ঠিক অ-এর মত উচ্চারিত হয়, কিন্তু নই এর অ ও এর মতো উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ একই অ কখনো অ-এর মতো, আবার কখনো ও এর মতো আচরণ করছে।

আমরা বলি একটি একটি করে উদাহরণ দেব। আর যখন বলবো, না, একটি নয়, একটা একটা করে উদাহরণ দেব। এই যে একটি এবং একটা। যখন টি বলছি তখন এ অবিকৃত থেকে এ এর মতো আচরণ করছে। কিন্তু যখন টা বলছি তখন এ ভোল পাল্টে অ্যা এর মতো আচরণ করছে।

তোমাদের মতি যদি ঠিক থাকে, তবে গতিও ঠিক থাকবে, আর তাতে তোমাদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না বললেই চলে।

 সমস্যা নম্বর তিন : প্রাণ মানে বাতাস। যে বর্ণ উচ্চারণ করতে বাতাস কম লাগে তাকে বলা হয় অল্পপ্রাণ, আর বাতাস বেশী লাগলে তাকে বলি মহাপ্রাণ। বাঙলা বর্ণমালায় যে পাঁচটি বর্গ আছে, ওই প্রতিটি বর্গের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ বর্গগুলি হচ্ছে মহাপ্রাণ। খ-ছ-ঠ-থ-ফ-ঘ-ঝ-ঢ-ধ-ভ এই দশটি বর্ণকে যদি আমরা আলাদা করে ফেলি এবং তাদের যথাযথ অনুশীলন করি, তবে প্রাণগত সমস্যার উত্তরণ ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। নরেন বিশ্বাস বাংলাদেশ টেলিভিশনে একদিন রেকর্ডিং এ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশী সময় ব্যয় হওয়ায় এক ছাত্রকে বললেন যে তুমি ফেরার পথে আমার বাসা হয়ে যেও। তোমার বৌদিকে জানিয়ে দিও, আমার ফিরতে দেরী হবে। তারা যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। সে বললো কি জানো? বললো, স্যার আপনার বাসায় গিয়ে বৌদিকে কবর দিয়ে দেব

আমরা আমরা খাচ্ছি।

উচ্চারণ বিভ্রাটের ফলে ভাত হয়ে যায় বাত, খাল হয়ে যায় কাল, ঝাল হয়ে যায় জাল, কথা হয়ে যায় কতাঅন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে এর স্থলে যদি বলা হয় অন্দ হলে কি প্রলয় বন্দ থাকে তাহলে অবস্থা কোন পর্যায়ে যায় তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছো? ডাক্তার যদি নাড়ী ধরার পরিবর্তে নিত্যনূতন নারী ধরা শুরু করেন, তাহলে ডাক্তারী পেশা না, তার জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে না?

সমস্যা নম্বর চার : আঞ্চলিক ভাষাকে অবহেলা বা উপেক্ষা করতে বলছি না। যখন তুমি মায়ের কাছে বা গাঁয়ে যাবে বা আঞ্চলিক কোন চরিত্রে অভিনয় করবে তখন আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বললে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু যখন সবার জন্য বলবে বা সভাতে বলবে তখন আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করবে। তবে একটি কথা তুমি যদি সারাক্ষণ পা টেনে হাঁটতে থাকো, তবে তোমার হাঁটার ঐ বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে হঠাৎ তোমার হাঁটাহাটি সুন্দর করতে পারবে না। সুন্দর হাঁটার জন্য তোমাকে সব সময়ই সুন্দরভাবে পা ফেলার অনুশীলন করে যেতে হবে। ঠিক সেরকমই, প্রমিত ভাষার উচ্চারণ দক্ষতা অর্জনের জন্য বা উত্তরণের জন্য তোমাকে আঞ্চলিক ভাষার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষাকে বর্জন করে প্রমিত ভাষার উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে উঠার জন্য এর কোন বিকল্প নেই।

সমস্যা নম্বর পাঁচ : এটি হলো আমাদের জাতীয় সমস্যা তোমাদের সুন্দর পোষাক পরিচ্ছদ ও মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে সময় ব্যয় করে থাকো, মুখের ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সেই সময়টুকু ব্যয় করো কিনা, তা তোমরা হলফ করে বলতে পারবে? একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তৃতা দেয়ার সময় অবলীলায় বলেছেন সনমানিত সবাপতি। কিন্তু তিনি কি ইংরেজি বক্তৃতা দেবার সময় বলবেন হনারেবল ফ্রেসিডেন্ট। কখনোই তিনি এমন ভুল করবেন না। কারণ তিনি ইংরেজি শেখেন। রপ্ত করেন, কিন্তু বাঙলা তাঁর মাতৃভাষা হলেও এটি শেখার জন্য কোন গরজ অনুভব করেন না।

আরও লেখা

ইতিহাস

উত্তাল মার্চ

জাহীদ রেজা নূর বিক্ষোভ, সভা আর মিছিল আমরা তো ভুলে যাইনি, ১লা মার্চ সংসদ অধিবেশন

ভাষা নিয়ে কথা
ইতিহাস

ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা কথা

জাহীদ রেজা নূর ভাষা ছাড়া কি মানুষ হয়? মানুষের সবচেয়ে জটিল সৃষ্টি হলো ভাষা। কোত্থেকে,

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top