দলের সবচেয়ে ছোট যে দুজন, ওরা গুগল ঘেঁটে ইংরেজিতে বলল, ‘জনস বিচে না, আমরা মোজেস বিচে যাব।’
মোজেস সৈকতটি জনস সৈকতের চেয়ে ভালো কিনা জানতে চাইলে ওদের জবাব, ‘তা জানি না, ওটা একটু দূরে। গাড়িতে ঘুমিয়ে নিতে পারব।’
নিউইয়র্কেই বড় হয়েছে প্রবন্তী–শ্রেয়ন্তী। এখানকার স্কুলেই পড়ে। এখন চলছে গ্রীষ্মাবকাশ। তাই ওদের দিন–রাত সব এক হয়ে গেছে। গতদিনই ঘুম থেকে উঠেছে বিকেল চারটায়, তখন শুরু হয়েছে দিন। ফলে ওদের কাছে দুপুর সাড়ে বারোটায় কুইনস ভিলেজ থেকে লং আইল্যান্ডের মোজেস বিচের দিকে রওনা দেওয়ার মানে হলো গভীররাতে ভ্রমণ।ফলে ঘুম এখানে একটা বড় ব্যাপার।
ভাষা এক অদ্ভুত জিনিস। যে দেশে, যে আবহাওয়ায় বড় হয় মানুষ, সে ভাষা সেভাবেই রপ্ত করে নেয় সে। আমাদের কনিষ্ঠ দুজনও অনর্গল ইংরেজি বলে নিউ ইয়র্কের আঞ্চলিক ভাষায়। যারা বড় হয়ে বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছেন, এখানে কাজ করে করে মার্কিন নাগরিক হয়ে গেছেন, তাদের ভাষায় বাংলাদেশি ইংরেজির টান রয়ে গেছে। কখনো কখনো ‘ক’–‘খ’, ‘ট’–‘ঠ’ উচ্চারণে বাংলাদেশি আবেশ ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাটাও আছে তাদের।তবে সেই অভিবাসীদের অনেকেই নিখুঁত ইংরেজি বলেন, যারা দেশে একেবারেই ইংরেজি বলেননি। তারা বাংলা বলেন অপ্রমিত ভাষায়, কিন্তু ইংরেজিটা হয় দারুণ! ইংল্যান্ডে গিয়ে সিলেটি বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, যারা একেবারে গ্রাম থেকে সরাসরি ইংল্যান্ডে এসেছেন, তারা ইংরেজিটা বলেন নিখুঁত ব্রিটিশ উচ্চারণে, বাংলায় কথা বলতেই পারেন না, বলেন সিলটি। এটা আমরা দেখেছি, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘জলে ডাঙায়’ বইটিতেও। জাহাজের খালাসিরা বন্দরগুলোর নাম উচ্চারণ করেন স্থানীয় ভাষায়। মোটেই ইংরেজি থেকে ধার করা শব্দ দিয়ে নয়।
আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়, বাঙালি বাবা–মায়ের যে সন্তান দেশের বাইরে অন্য ভাষাবলয়ে বড় হয়ে উঠছে, সে নিজের মস্তিষ্কেই একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে নেয়। ওরা বিদেশি ভাষায় পড়াশোনা করে, কিন্তু ওদের জন্য সেটাই হয়ে ওঠে প্রথম ভাষা। বাড়িতে কিংবা পাড়ায় বাঙালিদের মিলনমেলায় ওরা বাংলা ভাষা শোনে। ফলে এক অদ্ভুত সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে ওদের ভাষা শিক্ষা এগিয়ে যেতে থাকে। বাবা মা ওদের প্রশ্ন করেন বাংলায়, ওরা নির্দ্বিধায় উত্তর দেয় ইংরেজি বা ওই দেশের ভাষায়। ওরা হয়ত বলল, ‘আই নিড ফুড’, মা বাংলায় বললেন, ‘ফ্রিজে পিৎজা রাখা আছে, গরম করে খেয়ে নাও।’ দুজনেই বুঝল কী বলা হচ্ছে।কথোপকথনে বাংলা–ইংরেজির এই সহাবস্থান প্রবাস জীবনে ঘটেই চলেছে।
চার পরিবার মিলে আমাদের এই দলটায় এই তিন ধরনের মানুষই আছে। কেউ এখানে এসেছেন যৌবনে, কারো জন্ম এ দেশে, কেউ বেড়াতে এসেছে কিছুদিনের জন্য (যাদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলায় ভেবে ইংরেজিতে অনুবাদ করে কথা বলেন)।
গাড়িতে ওঠার পর পরই একটি ফোন। ‘হ্যালো, তোমরা চলে এসো জনস পার্কে। ওখানে আমরা পিকনিকে এসেছি। জয়েন করো। খুব আনন্দ হচ্ছে।’
লোভ ছিল পিকনিকে কী হয় দেখার। কিন্তু নিউ ইয়র্কের গ্রীষ্মে পিকনিক লেগেই আছে। প্রতি রোববারেই পিকনিকে যায় মানুষ, তাই কোনো না কোনো পিকনিকে পরেও যাওয়া যাবে—এ কথা ভেবে আমাদের দুই গাড়ি স্টার্ট নেয়।
মনে করার কোনো কারণ নেই, যে দুজন গাড়ি চালাচ্ছেন, তারা প্রতিদিন একবার করে লং আইল্যান্ড পার হয়ে মোজেস বিচে বেড়াতে যান। আসলে প্রায় ৪০ বছর নিউ ইয়র্কে থেকেও কেউ কেউ এই বিচে যাননি। ফলে সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থাই নেওয়া হয়। ফোনে সেট করা হয় জিএসপি। জিএসপিই পথ দেখায়।
আমাদের গাড়ি চলছিল ৫০–৫৫ মাইল গতিতে। বাংলা মুল্লুকে এখন আর মাইলের চল নেই, কিলোমিটার হয়ে গেছে। তাই স্পিডোমিটারের দিকে তাকালে মনে হতে পারে, মাত্র ৫৫ কিলোমিটার! আসলে তা মাইলে, অর্থাৎ প্রায় ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলছে গাড়ি।
কুইন্স ভিলেজ থেকে বেরিয়ে লং আইল্যান্ড দিয়ে গাড়ি যখন এগোচ্ছে, তখন জিপিএস জানিয়ে দিচ্ছে কোন পথ নিতে হবে। চালক দুজন একটু ধাতস্ত হয়ে একমত হন—জিপিএস অন্তত ৫ মাইল পথ কমিয়ে দিয়েছে।
আমরা যখন প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পেরিয়েছি, তখনই প্রথম আটলান্টিকের দেখা পেলাম। সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ‘অতলান্তিক’… অতল জলের ‘অতলান্তিক’। তার জলে গা ভাসিয়ে দিয়েছে কয়েকটি স্পিড বোট। ভালোই লাগছে দেখতে।
গ্রীষ্মে ইউরোপ–আমেরিকার মানুষ সমুদ্র খোঁজে। শীতের পুরো সময়টায় শরীর থাকে গরম কাপড়ে ঢাকা, চামড়া হয়ে যায় ফ্যাকাশে, তাই গ্রীষ্মের সময় শরীরে নুনে–মাখা সমুদ্রের পানি ওই ফ্যাকাশে ভাবটা কাটিয়ে দেয়।
সৈকতে স্বল্পবসন নিয়ে বাঙালিদের মনে যে ভীতি বা লজ্জা আছে, তা খুবই হাস্যকর। মানছি, এটা আমাদের ঐতিহ্য নয়। কিন্তু ইউরোপ–আমেরিকার মানুষের জন্য স্বল্পবসনে স্নান করা ও রোদ পোহানো শরীর ঠিক রাখার মহৌষধ। তাই স্বল্পবসন কি আলখাল্লা, সেটা বিবেচনার কোনো বিষয় নয়। নিজের স্নান–রৌদ্রস্নানের দিকে নজর দিলে এবং সমুদ্রের কলগীতির মুর্ছনায় অবগাহন করলে অন্যের পোশাকের দিকে চোখ যাওয়ার তো কথা নয়। আর গেলেও তা সাধারণ ব্যাপার বলেই মনে হবে। অন্তত আমার ইউরোপ–আমেরিকায় অবস্থানের অভিজ্ঞতা তো সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
সৈকতে ঢুকতে হলো গাড়িপ্রতি ১০ ডলার দিয়ে। দুপুরের মোজেস সৈকতে নরম বালু গরম হয়নি। পা পুড়ে যাচ্ছে না, বরং আলতোভাবে পায়ে জড়িয়ে যাওয়া বালু যেন বলছে, ‘তুমি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছ সাগরের দিকে, আমিই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
আটলান্তিকের ঢেউ প্রবল। মহাসাগর বলেই কী? এর আগে আমি কৃষ্ণসাগর আর বঙ্গোপসাগরের কাছে গেছি।আটলান্টিককে মনে হলো, একটু বেশি বুনো। হঠাৎ করেই বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল শরীরে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, আনাপা, সোচি কিন্তু এত উত্তাল নয়। ঝড়ের আগে হয়তো তারা উন্মত্ত, কিন্তু সাধারণ সময় তাদের ঢেউ আলতো এসে ছুঁয়ে যায় পায়ের পাতা। আমাদের মধ্যে যারা আটলান্টিকের হাটুজল পার হবে না বলে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিল, অনতিবিলম্বে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই তাদের পুরো শরীর ভিজিয়ে দিয়ে গেল মহাসাগর। ফলে জড়তা কাটিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে মিলমিশ করে নিতে সমস্যা হলো না কারো। মহাসাগরের জল ঠাণ্ডা, শরীর জুড়িয়ে যায় তাতে।
যারা সৈকতে এসেছেন, তাদের মধ্যে লাতিন, আফ্রিকান ও এশিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষই বেশি। সবাই বাড়ি থেকে ছাতা, বসার চেয়ার কিংবা তোয়ালে নিয়ে এসেছেন। একজন তো সঙ্গে করে এনেছেন তাবু। সেই তাবুর মধ্যে মহারানির মতো শুয়ে আছেন তিনি। দেখতে মোটেই খারাপ লাগল না। আমরাই কেবল বালুতে বিছানোর জন্য কিছু আনিনি। সমুদ্রপাড়ের বায়ুসেবনের ভাবনা যে স্নানে পরিবর্তিত হয়ে যাবে, সে কথা কে জানত? আমাদের মধ্যে দু–একজন কেবল আগেই টের পেয়েছিল, আটলান্টিক বিনা আপ্যায়নে ছাড়বে না, তাই সঙ্গে নিয়ে এসেছিল বাড়তি কাপড়চোপড়। তারা বেঁচে গেল এ যাত্রা। আমরা যারা আটলান্টিকের অযাচিত আপ্যায়নে দিশেহারা হলাম, তারা স্নানের পর আরো আধঘণ্টা সূর্যের কাছাকাছি হয়েই কেবল জামাকাপড় শুকাতে পারলাম।
সমুদ্র স্নানে গেলে যা হয়, সঙ্গে থাকে হালকা খাবার। অনেকক্ষণ পানিতে থাকার পর পেটে থাকে রাক্ষুসে খিদে। সেই খিদে মেটানো হলো পলির বানানো অল্প চিনির কেক, দোকানে কেনা দু রকম চিপস আর ফলের রসে।
মোজেস সৈকত থেকে পড়ন্তবেলায় বেরিয়ে গাড়ি থেকে ফলের জুস খেতে খেতে মনে হলো, সমুদ্রের সঙ্গে এই যে কথাবার্তা, তাতে বুঝি প্রাণ আছে। অন্তত প্রাণকে বড় করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সমুদ্রের জুড়ি নেই।
১০ ডলারে এক গাড়ি মানুষ ঢুকে গিয়েছিল আটলান্টিকের বুকের ভেতর। মোজেস সৈকত থেকে বের হয়ে আমাদের মনে হলো, এ গ্রীষ্মেই আবার ফিরতে হবে এখানে। এবার আসতে হবে পুরো তৈরি হয়ে, যেন প্রবল উন্মত্ততায় আমাদের শরীরে আছড়ে পড়লেও আটলান্টিককে বলতে পারব, ‘তোমার কাছে প্রস্তুত হয়েই এসেছি।’