১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে দেশের জন্য লড়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর পুরোপুরি জড়িয়ে যান মঞ্চনাটক আন্দোলনে। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় দিয়ে বড় পর্দায় যাত্রা। পরে অসংখ্য চলচ্চিত্র, নাটকে অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন গতকাল ২৫ মার্চ কথা হলো রাইসুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে।
আসাদ ভাই, করোনাভাইরাসের যুগে কেমন আছেন?
এই তো। আছি তো!
সারা পৃথিবীই একটা ভয়াবহ সময় পার করছে…
সেটা ঠিক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কী বলছেন? বলছেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙা করতে হবে। অথচ মানুষ করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত আছে, মানুষ মরে যাচ্ছে। সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। এখন সারা পৃথিবী তার অর্থনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এবং অস্ত্র নিয়ে ব্যস্ত। অর্থনীতি যখন অন্য সবকিছু ছাড়িয়ে সবার ওপরে উঠে যায়, তখন বাছবিচারের সময় আর থাকে না। সারা পৃথিবীতেই এই ঘটনা ঘটছে। একটা দেশই বুঝি এই প্রক্রিয়ার বাইরে আছে—ভুটান। অবশ্য এসব বলে কোনো লাভ হয় না। এ নিয়ে আর বলতে চাই না।
না না আসাদ ভাই, বলেন। আপনারা না বললে এ নিয়ে বলবেটা কে?
একটা কথা বলি। বলে কোনো লাভ নেই। আমাদের করোনাভাইরাস নিয়ে এত কথা হচ্ছে, কিন্তু কেউ কি শুনছ? এই যে আজ (গতকাল) খালেদা জিয়া মুক্তি পেলেন। তাঁর দল থেকে বলা হলো ভিড় না করতে। কেউ কি শুনল?
১০ বছর পর এটা যদি কেউ পড়ে, তাহলে কেউ না কেউ বুঝবে, এসব কথা কেউ কেউ বলেছে।
কিন্তু তার তো কোনো প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়ে না। এর উত্তর তো আপনিই দিয়েছেন। অর্থনীতিকেই যখন সবচেয়ে বড় করে দেখছি, তখন তো আমরা আর অন্য কিছু দেখছি না। এমনকি মানবতাকেও না।
এটা চলতে চলতে চলতে চলতে এমন এক অবস্থায় চলে এসেছে, যা বিস্ময়কর। ফেসবুকে একটা ছবি দেখলাম, একটা ফেরিতে গায়ে গা লাগিয়ে চলেছে মানুষ। আমরা বাঙালিরা এটা কী করছি?
যুদ্ধের সময় একটা স্বপ্ন তো ছিল আপনাদের। মানবিকতা ছিল। সেটা কি একেবারে নেই হয়ে গেল এ সময়ে? আমার মনে পড়ছে ‘হে জনতা আর একবার’ নাটকটির কথা।
সে নাটকের শেষ সংলাপ ছিল, অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দিইনি। আজ সেই ট্রেনিং জমা দিলাম। হ্যাঁ, খুব ভালো লাগার একটা সময়কে মনে করিয়ে দিলে। রেসকোর্সের বিশাল মঞ্চে নাটকটি হয়েছিল। ওই নাটকে এক দিনের নোটিশে অভিনয় করেছিল নায়লা আজাদ নুপুর। ওই চরিত্রে যার অভিনয় করার কথা ছিল, সে আগের রাতে চলে গেল। নাটকটি লিখেছিল আর নির্দেশনা দিয়েছিল আল মনসুর। ১৬ ডিসেম্বরে প্রেস শো ছিল সকালে। নাজ সিনেমা হলে। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবির। সেই প্রেস শোর পর আমরা চলে গেলাম রেসকোর্সে। নাটকে অভিনয় করলাম। একই দিনে সিনেমার প্রেস শো আর নাটক।
তখন কি হতাশা ছিল আপনাদের মনে?
হতাশা তখন ছিল না। আমরা অস্ত্রই জমা দিয়েছি বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর। বাহাত্তর সাল তো দেখতে দেখতে চলে গেল। আমাদের সামনে তখন নাটক ছাড়া আর কিছু নেই। শুধু নাটক করছি। তখন কিচ্ছু নেই দেশে। সব ধ্বংস করে গেছে পাকিস্তানিরা। তাই তখন তো হতাশা আসতে পারে না। হতাশার গল্প তো পরে কায়দা করে ঢোকানো হলো। নানা রকম গুজব ঢোকানো হলো। যেমন ধরো, কামাল ভাইকে নিয়ে নানা মিথ্যা গল্প ফাঁদা হলো। কামাল ভাই সংস্কৃতিবান মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকও করেছি। ‘দানব’ নাম ছিল নাটকটির। কিন্তু তাঁকে নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হলো।
হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়ে অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে।
একটা গল্প বলি শোনো। দেশ স্বাধীন হলো। কলকারখানার মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। দেখা গেল, শ্রমিকেরা কারখানার বাইরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কাজে যায় না। কারণ কী? কারণ, এখন তো আমরা এই কারখানার মালিক। মালিক তো কাজ করে না। আমরা কাজ করব কেন? এই ছিল বাস্তবতা। অথচ দেখো, মুক্তিযুদ্ধে কৃষকেরা অংশ নিয়েছিল, তারা কিন্তু যুদ্ধের পর নিজেদের কাজে চলে গেছে। তারা কোনো কিছু দাবি করতে আসেনি, কোনোকিছু নষ্ট করতে আসেনি। নষ্ট করল কারা? লেখাপড়া জানা লোকেরাই। যারা চাকরি খুঁজতে গেছে। চাকরি খুঁজতে গিয়ে যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার নকল সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। একটু খেয়াল করলেই দেখবে, এসব লুটপাট অশিক্ষিত মানুষ করেনি, শিক্ষিতরাই করেছে।