আবার এল যে সন্ধ্যা | জাহীদ রেজা নূর

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email


‘আবার এল যে সন্ধ্যা’
কেউ কি তাঁকে মনে রেখেছে?
সুরমুর্চ্ছনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষটিকে নিয়ে কি কোথাও কোনো আলোচনা হয়?
মাঝে মাঝে কোথাও কখনো ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ গানটি ভেসে উঠলে চমকে উঠি! ফিরে যাই আমাদের কৈশোরে। কিংবা তারও আগে—শৈশবে। যখন থেকে লাকি আকন্দ, হ্যাপি আকন্দের ভালোবাসা পেয়েছিলাম।

আমাদের শৈশব মানেই তো যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ—সবকিছু ভেঙে পড়া এক দেশের পুনর্গঠন। মনে পড়ে, আজম খানের রিহার্সেল দেখা, সেলিম আল দীন-নাসিরউদ্দি ইউসুফ-আল মনসুরদের আড্ডার মাঝে হাজির হওয়া। আর হ্যাঁ, গিটার হাতে লাকি ভাই-হ্যাপি ভাই।

আজ হ্যাপি আকন্দের জন্মদিন। হঠাৎই মনে পড়ল তাঁকে। জন্মদিন ধরেই কথা বলি লাকি আকন্দের সঙ্গে। ছোট ভাইকে যিনি দেখেছেন অনেক কাছে থেকে। অকালে হ্যাপিকে হারিয়ে যার মনের শূন্যতা পরিমাপের ঊর্ধে। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের কবিতায়ই তো পেয়ে যাই, ‘শূন্যতাই জান শুধু, শূন্যতার ভেতরে যে ঢেউ থাকে, সে কথা জানো না?’ সেই ঢেউয়েরই সন্ধান করি লাকি আকন্দের মধ্যে।

লাকি ভাই, বহুদিন পর কথা হচ্ছে। কেমন আছেন? কথা বলব হ্যাপি ভাইকে নিয়ে।


ভালো আছি। হ্যাঁ, ১২ অক্টোবর ওর জন্মদিন। ভালোই করেছ, আজ ফোন করে। মানুষ তো শুধু মৃত্যুদিন নিয়েই ভাবে। জন্মদিনটিতেও যে স্মরণ করা যায়, সেটা ভাবে না।

হ্যাপি ভাইকে নিয়েই কথা বলতে চাই, লাকি ভাই।
ওর কথা মনে হলে, সবচেয়ে আগে মনে হয়, ওকে যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি আমরা। কষ্টই দিয়েছি বেশি। ও ছিল সংগীত-অন্তপ্রাণ।

কথা-প্রসঙ্গেই মনে ভেসে ওঠে বেশ কিছু গানের কথা, ‘পাহাড়ি ঝরনা’, ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘কে বাশি বাজায়রে’, ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে গান তো লিখেছি’। গানগুলোর সুর করেছিলেন লাকি আকন্দ। গেয়েছিলেন হ্যাপি আকন্দ।

তোমাকে একটা কথা বলি, আমাদের সংগীত অঙ্গনে তো অর্কেস্ট্রাল শিক্ষাটা ওভাবে ছিল না। শেখ লুৎফর রহমান, সমর দাস, এ কে আবদুল হক বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন। গিটার বলতেও তো ছিল শুধূ হাওয়াইন গিটার। অ্যাকোর্ডিয়ান, পিয়ানো…এগুলোও আসতে শুরু করেছে। কিন্তু তখন রেডিও পাকিস্তানে তাঁদের সেভাবে জায়গা হয়নি। আমরা অর্কেস্ট্রাল শিক্ষাটাকেই ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আর শোনো, হ্যাপি সেই পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই খুব ভালো তবলা বাজাত। মধু মুখার্জিকে চেনো? কলকাতার মধু মুখার্জি? ওর সংগীতায়োজন খুব ভালো। ১৯৭৫ সালে হ্যাপির কাছ থেকে কিছু টিপস নিয়েছিলেন মধু। কিছূদিন আগে ওঁর সঙ্গে দেখা হলো। ও বলল, হ্যাপি তাঁকে যে লেসন বা টিপসগুলো দিয়েছিল, সেগুলো না পেলে তিনি এতদূর আসতে পারতেন না। শুনে ভালো লাগল।

স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর গানগুলোর কথা আমাদের মনে পড়ে যাবে। ‘ইসকুল খুইলাছে রে মওলা’, ‘ও গরিয়া, থাকিস তুই এত কাছে’, ‘ড্যাগের ভিতরে ডাইলে-চাইলে খিচুরি’ ইত্যাদি গানের মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন হ্যাপি আকন্দ। গানগুলো খঁুজে আনা নিয়েও একটা গল্প আছে। লাকি ভাইয়ের কাছে সে কথাও জানতে চাই।

‘হ্যাঁ, কামাল ভাই (শেখ কামাল) একদিন বললেন, স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর জন্য কিছূ আঞ্চলিক গান জোগাড় করে দিতে। বলেছিলেন, তুই কিছু ভাবিস না। তোর জন্য একটা নাগড়া টেপ রেকর্ডার আর একটা জিপ গাড়ি কিনে দেব। গানগুলো জোগাড় করলাম, স্পন্দন করল সে গানগুলো। কিন্তু কামাল ভাই তো মারা গেলেন।
হ্যাপি ভাইকে নিয়ে ভাবতে গেলে কোন কথাটা আপনার মনে আসে?

‘কত কথাই মনে পড়ে! ১৯৭৫ সালের এক বিকেল। আমি কলকাতায় বনশ্রী সেনগুপ্তের বাসায় মান্না দে’র দেখা পেয়ে গেলাম। সঙ্গে ছিল হ্যাপির গাওয়া ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ গানটির রেকর্ড। সেটা বাজিয়ে শোনালাম। মান্না দে বললেন, কে গাইছে? বললাম, হ্যাপি, আমার ছোট ভাই। মান্না দে বললেন, ও দারুণ গায়, চমৎকার থ্রোয়িং!’ সে বছরই পশ্চিমবঙ্গের দূর্গাপুর স্টিল মিলে—ওই যে বহরমপুরে— আশা ভোসলে আর আর ডি বর্মনের সঙ্গে দেখা। সেখানে গিটার হাতে হ্যাপি গেয়ে শোনালেন আশা আর আর ডি বর্মনের অনেকগুলো গান। উপস্থিতজনেরা মুগ্ধহৃদয়ে সে গান শুনতে লাগল! ‘স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে’, ‘চলেছি একা কোন অজানায়’, ‘বেনারস বাবু’সহ আরো অনেক গান করেছিল হ্যাপি। রাহুল দেব বর্মন বললেন, তুমি বোম্বে (এখন মুম্বাই) আমার ফ্ল্যাটেই উঠবে। আমি তোমার গান রেকর্ড করব। কিন্তু হ্যাপি আর যায়নি।

ঘুড্ডি ছবিতে হ্যাপি আকন্দের ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ গানটি আছে। ওটা নিয়ে কিছূ কথা জানতে চাই।
পরিচালক সালাউদ্দিন জাকী আমাকে বললেন, তুমি নিজের ইচ্ছেমতো মিউজিক করো। পুরো স্বাধীনতা তোমাকে দিলাম। আমি সেই ছবিতে হ্যাপির এই গানটি ব্যবহার করেছিলাম। রেকর্ডিং-এ অংশ নিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, মাইলসের শাফিন, কমল (এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে)। যতদূর মনে পড়ে সিন্েথসাইজারে ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, সুরমণ্ডল বাজিয়েছিল হামিন বা সাফিন। গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

হ্যাপিকে নিয়ে কোনো ভাবনা আছে?
সামনের নভেম্বরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হ্যাপিকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হবে। আলোচনা হবে। ওর যে সম্মানটুকু পাওনা ছিল, সেটা ওকে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। ও অনেক বড় সংগীতরসিক ছিল। আমাদের সম্পর্কটাও ছিল ওই রকম—আমার আদরের ছোট ভাই। আমরা দুই ভাই অনেক গান করেছি একসঙ্গে। ১৯৬৮ সালে বুদ্ধু অ্যান্ড কোং-এর বুদ্ধুদাকে দিয়ে একটা স্প্যানিশ গিটার বানালাম। তিনি তো বানাতেই চাননি। অনেক অনুরোধের পর বানালেন। ২৫০ টাকা দাম হলো সেটার। দুভাই মিলে সে গিটার নিয়ে কত গান যে করলাম!

লাকি আখন্দকে স্মৃতির ভেলায় ভাসিয়ে দিই আমরা। এখন নীরবতাই ভালো। এ নীরবতার ভাষা সবাই বুঝবে কি না, জানি না।
হ্যাপি ভাইকে কি ভুলে যাবে এই দেশ? নাকি যুদ্ধোত্তোর বাংলাদেশে যে তরুণেরা আমাদের সংগীতকে রাঙিয়ে দিচ্ছিল নানা রঙে, তাদের আমরা মনে রাখব? হ্যাপি আকন্দ কি সেই তালিকায় থাকবেন না?

আরও লেখা

তুষারকন্যা
শিশু ও কিশোর সাহিত্য

তুষারকন্যা

রুশদেশের উপকথাঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ি। ভালোই তো ছিল

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top