এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মিছিলে গুলির প্রতিবাদে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে যে স্মৃতিস্তম্ভটি গড়ে উঠেছিল, সেটি নির্মাণ করা শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, কাজ শেষ হয়েছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। ভাষাসংগ্রামীদের কেউ কেউ তাদের স্মৃতিচারণায় তারিখটি ২১ বা ২২ বলেছেন। তাঁদের কথা অনুসরণ করলে নবীন পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখটিই এখন সর্বজনস্বীকৃত। এবং প্রমাণিত সত্য।
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ধারণা প্রথম কার মাথায় এসেছিল, সেটা এখন আর জানার উপায় নেই। ২২ ফেব্রুয়ারিই দেয়ালে দেখা যায় দু-একটি পোস্টার, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। শোকসাগরে ডুবে আছে তখন ছাত্র-শিক্ষক-জনতা। যেখানে পুলিশের নির্মম গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ভাষাশহীদরা, সেখানেই গড়তে হবে স্মৃতির মিনার। এ কথা জনে জনে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন তৎপর হয়ে ওঠেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি (ভিপি) গোলাম মওলা ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) শরফুদ্দীনের সঙ্গে অন্য শিক্ষার্থীরাও। সে সময় নির্মাণসামগ্রীর অভাব ছিল, তবে অভাব ছিল না মানসিক প্রস্তুতি ও কর্মস্পৃহার। এবং এ কথা এখন বলতেই হবে, এই স্মৃতিস্তম্ভটি গড়ে তুলেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাই। মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলম করেছিলেন প্রথম নকশা। সেটি কিছুটা পরিবর্তন করতে হলে তাঁকে সহযোগিতা করেন সাঈদ হায়দার। কয়েকটি খসড়া নিজেরাই বাতিল করে তারা একটি নকশা দাঁড় করান। অন্যরাও এটি পছন্দ করেন। নকশাটি ছিল বলিষ্ঠ ভিত্তির ওপর প্রতিবাদের প্রতীক। এই স্মৃতিস্তম্ভের শৈল্পিক মান খুব একটা উন্নত ছিল না। তবে দ্রুত নির্মাণই যেহেতু ছিল অভীষ্ট লক্ষ্য, তাই শৈল্পিক মান ধরে রাখা না রাখা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল না তখন।
মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলম করেছিলেন প্রথম নকশা। সেটি কিছুটা পরিবর্তন করতে হলে তাঁকে সহযোগিতা করেন সাঈদ হায়দার। নকশাটি ছিল বলিষ্ঠ ভিত্তির ওপর প্রতিবাদের প্রতীক।
এ ব্যাপারে ডা. সাঈদ হায়দার জানাচ্ছেন, ‘প্রথম শহীদমিনারের নকশা অঙ্কন বদরুল ও আমার জন্য গৌরবের হতে পারে, ছাত্রনেতা শরফুদ্দীনের সক্রিয়তা নির্মাণকাজে উৎকর্ষ আনতে পারে, ভিপি মওলার সার্বিক তত্ত্বাবধান সবার কাজকে সুসমন্বিত করতে পারে, আহমদ রফিকের কুশলী সতর্কতা নির্মাণস্থলকে নিরাপদ রাখতে পারে, আলী আজগরের কর্মতৎপরতা নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ সহজ করতে পারে, সবলদেহী আবুল হাশিম, সনজুর, আসাদুজ্জামান, আবদুর রশিদ, মামুনুর রশিদ, ফজলুল মতিন, শাহজাহান, হুমায়ুন হাই, সালাম, জহুরুল, জোরো, জিয়া—এসব নিবেদিত হাতের ছোঁয়া ও শ্রম অতি কম সময়ে অতি বড় একটা কাজ সম্পাদন সম্ভব করতে পারে, কিন্তু প্রথম শহীদমিনার নির্মাণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই মিনার ছিল ব্যারাকবাসী সব মেডিকেল ছাত্রের রাতভর স্বতঃস্ফূর্ত সম্মিলিত শ্রমের ফসল।’
শহীদ মিনারটি কাঠামো শেষ করার পর ওই কাঁচা অবস্থাতেই প্লাস্টার করা হয়। নকশায় ছিল ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া হবে মিনারটি। মেপে দেখা গেল উচ্চতা সাড়ে ১০ ফুট ছাড়িয়ে গেছে। বিস্তর সিমেন্ট ব্যবহারে মজবুত ছিল গাঁথুনি। তখন ভোর হয়ে গেছে। বদরুল আলম লিখলেন একটি ফলক—‘স্মৃতিস্তম্ভ’। ফলকটি সাবধানে সেঁটে দেওয়া হলো মিনারের বুকে। একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো স্মৃতিস্তম্ভটি। চারদিকে ছোট ছোট খুঁটি পুঁতে দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হলো স্থাপত্যটি। দড়ির গায়ে মিনারের চারপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো কয়েকটি রক্তিম পোস্টার, যেগুলোয় লেখা ছিল: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো’ আর ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করুন’।
বেলা যত বেড়েছে, দর্শনার্থীও বেড়েছে ততই। পরবর্তী দুই দিন ফুল আর চোখের পানিতে মহিমান্বিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভটি। যে যতটুকু পেরেছেন, ততটুকুই দান করেছেন তহবিলে।
একথা বললে অন্যায় হবে না যে, ভাষা আন্দোলনে ঢাকায় তৈরি প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদমিনার নির্মাণের কৃতিত্ব এককভাবে কারো উপর দেয়া যাবে না। এটি ছিল মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের যৌথ চিন্তা ও যৌথ শ্রমের সম্মিলিত প্রয়াস।
একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর গুলিতে যেখানে ভাষা শহীদরা জীবন দিয়েছিলেন, সেখানেই শহীদ মিনার নির্মাণের স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল। ১২ নং ব্যারাকের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল আবুল বরকত। স্মৃতিস্তম্ভটি সেখানেই নির্মিত হয়েছিল। আমি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের সঙ্গে কথা বলে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণের জায়গা দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, সেই স্মৃতিস্তম্ভটি যেখানে ছিল, সে জায়গাটি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফটো সাংবাদিকসহ সেখানে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করলাম, মেডিকেল কলেজের কর্মচারী ইউনিয়নের অফিস, খাবার দোকান আর ডিসপেনসারি রয়েছে যেখানে, সেখানেই ১৯৫২ সালে ছিল ১২ নম্বর ব্যারাক। ১২ নম্বর ব্যারাকের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হোস্টেলের দুই গেটের সংযোগ রাস্তার পাশে নির্মিত হয়েছিল এই স্মৃতিস্তম্ভটি। সেখানে ছিল সুড়কি ঢালা পথ। এখন তা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
২২ ফেব্রুয়ারিতে মিছিল-সভা আর পোস্টার আঁকা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। রাতে ক্লান্তিতে ঘুমে বিভোর ছিলাম হোস্টেলে। হঠাৎ মধ্যরাতে কয়েকজন বন্ধু আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বলল, তোমাকে মাওলা ভাই (তৎকালীন ভিপি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ) ডাকছেন। আমার আঁকার হাত ভালোই ছিল। তাই মাওলা ভাই ও আরো কিছু ছাত্র আমাকে বললেন, ভাষার জন্য ছেলেরা রক্ত দিল, এটা ধরে রাখার জন্য একটা স্মৃতিস্তম্ভের নকশা বানিয়ে দাও।
— বদরুল আলম
ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন বদরুল আলম। শুধু চিকিৎসাবিদ্যায় তিনি পারদর্শী ছিলেন না বরং নাচ, গান, অভিনয় অঙ্গনেও ছিলেন সুদক্ষ। পোস্টার–ফেস্টুন আঁকা, নাটক মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দৃশ্যপট আঁকা ও সাজসজ্জায় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন।
সে সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মাওলা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাদের মেডিকেল কলেজের ছাত্র বদরুল আলম খুব সুন্দর আঁকতে পারতো। আমি তাকে স্মৃতিস্তম্ভের একটি নকশা তৈরি করার জন্য অনুরোধ জানাই। তাকে ধরে নিয়ে আসা হলো।’
ডাক্তার বদরুল আলম বলেছিলেন, ‘২২ ফেব্রুয়ারিতে মিছিল-সভা আর পোস্টার আঁকা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। রাতে ক্লান্তিতে ঘুমে বিভোর ছিলাম হোস্টেলে। হঠাৎ মধ্যরাতে কয়েকজন বন্ধু আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বলল, তোমাকে মাওলা ভাই (তৎকালীন ভিপি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ) ডাকছেন। আমার আঁকার হাত ভালোই ছিল। তাই মাওলা ভাই ও আরো কিছু ছাত্র আমাকে বললেন, ভাষার জন্য ছেলেরা রক্ত দিল, এটা ধরে রাখার জন্য একটা স্মৃতিস্তম্ভের নকশা বানিয়ে দাও। তখন এত রাতে আমার মাথায় কিছুই আসছিল না। হঠাৎ মনে হলো, ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম, ওখানে খুব সুন্দর ইট বাঁধানো একটা স্তুপ ছিল। বাবা বললেন, এটা স্মৃতিস্তম্ভ। কেউ মারা গেলে তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এটা বানানো হয়। সেই স্তুপ কল্পনা করে একটি নকশা করলাম। কারো তেমন পছন্দ হলো না। পরে ভিক্টোরিয়া পার্কে সিপাহী বিদ্রোহের যে স্মৃতিস্তম্ভ আছে, সেটির আদলে একটি নকশা বানালাম। অধ্যাপক মির্জা মাজহারুল ইসলামের ঘরে বসে বানাই সেটা। সবার পছন্দ হলো।
(ডাক্তার আফজালুন্নেসা, প্রথম শহীদ মিনার, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮)।
কয়েক বার চেষ্টার পর নকশাটি তৈরি হয়। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন মেডিকেল ছাত্র সাঈদ হায়দার।
এ ব্যাপারে ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন, ‘২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বদরুল আলমকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে বেশ কয়েকজনের উপস্থিতিতে গোলাম মাওলা তাকে বলেছিলেন শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করে দিতে। বদরুল আলমকে এ কথা বলার প্রধান কারণ ছিল, তিনি ভালো আঁকতে পারতেন।… এই নকশার বাস্তবায়ন কিছু সময়সাপেক্ষ ভেবে গোলাম মাওলা, শরফুদ্দিন আহমেদ, জাহিদ হায়দার আলী চৌধুরী প্রমূখ নেতৃস্থানীয় ছাত্র নকশাটি কিছুটা সংশোধন করার পরামর্শ দেন। তখন বদরুল আলম সাঈদ হায়দার মিলে আরেকটি নকশা তৈরি করেন। এবারে বদরুল আলমের মনে কাজ করেছিল আন্টাঘর বা ভিক্টোরিয়া পার্কের মিনারের নকশা। দ্বিতীয় নকশাটি সকলের অনুমোদন লাভ করে।’ (আনিসুজ্জামান, দৈনিক প্রথম আলো, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২০১২)।
এখানে সশ্রদ্ধ চিত্তে পিয়ারু সরদারের নাম স্মরণ করা প্রয়োজন। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য ইট বালি ছিল সামনেই। কিন্তু সিমেন্ট ছিল গুদামে। গুদামের চাবি ছিল পিয়ারু সরদারের কাছে। গভীর সে রাতে গুদামের চাবি আনতে গিয়েছিলেন আহমদ রফিক ও আলী আছগর। তারা ঘটনার বর্ণনা করে পিয়ারু সরদারের কাছে গুদামের চাবি চাইতে তিনি নির্দ্বিধায় সে চাবি দুজনের হাতে তুলে দিয়ে দিয়েছিলেন।
২৩ ফেব্রুয়ারী রাতেই শুরু হয় স্তম্ভ বানানোর কাজ। শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে। প্রথম শহীদ মিনার তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো কলেজ প্রাঙ্গণ থেকেই জোগাড় করা গিয়েছিল। কলেজ সম্প্রসারণের জন্য সেখানে ছিল ইট বালু। সিমেন্ট সংগ্রহ করার জন্য সাহায্য নিতে হয় মোতালেব, পিয়ারু সরদারের। এই মিনার বানানোর সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে ব্যারাকে অবস্থানরত ছাত্ররা সবাই কাজ করেছেন।
এখানে সশ্রদ্ধ চিত্তে পিয়ারু সরদারের নাম স্মরণ করা প্রয়োজন। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য ইট বালি ছিল সামনেই। কিন্তু সিমেন্ট ছিল গুদামে। গুদামের চাবি ছিল পিয়ারু সরদারের কাছে। গভীর সে রাতে গুদামের চাবি আনতে গিয়েছিলেন আহমদ রফিক ও আলী আছগর। তারা ঘটনার বর্ণনা করে পিয়ারু সরদারের কাছে গুদামের চাবি চাইতে তিনি নির্দ্বিধায় সে চাবি দুজনের হাতে তুলে দিয়ে দিয়েছিলেন। এই দুই ছাত্রের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গবেষক এম আর মাহবুব। মো. আলী আছগর তাঁকে বলেছিলেন, ‘বদরুল আলম নকশা তৈরি করল। রাতে আমরা কাজ শুরু করলাম। কলতা বাজারের মোতালিব কন্ট্রাক্টরের সাব-কন্ট্রাক্টর ছিল পিয়ারু সরদার। আমি রাতে পিয়ারু সরদারের বাসায় যাই গুদামের চাবি আনার জন্য। উদ্দেশ্য গুদাম থেকে সিমেন্ট বের করা। আমরা কয়েকজন হেঁটে হেঁটে পিয়ারু সরদারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। পিয়ারু সরদার আমাদের কথা শুনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চাবি দিয়ে দিলেন। চাবি এনে গুদামের তালাটি প্রথম আমিই খুলি। সিমেন্ট বের করে দেওয়ার সাথে সাথে লাইন দিয়ে মেডিকেলের ছাত্ররা সিমেন্ট শহীদ মিনার নির্মাণের স্থানে নিয়ে যায়। কাছেই দুজন রাজমিস্ত্রি ছিল। তাদের ধরে নিয়ে আসি। আমরা তাদেরই সহায়তা নিই। আমরা সকল জিনিস ব্যবহার করে ২৪ তারিখ সকালে একজন কর্মচারীর হাতে পিয়ারু সরদারের চাবি হস্তান্তর করে চাবিটি তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলি। এভাবেই তৈরি হয় প্রথম শহীদ মিনার।’
আহমদ রফিক এম আর মাহবুবকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইট বালি সিমেন্ট বিশেষত সিমেন্ট গুদামের চাবি চাওয়ার কথা শুনেও পিছু হটলেন না পিয়ারু সরদার। বিশদ সবকিছু শুনে বাড়ির ভেতর থেকে চাবি এনে আমাদের হাতে চাবি দিয়ে জানালেন, অনেকটা সতর্কভঙ্গীতে, কাজ শেষ হলে চাবিটা যেন কাল তার হাতে ফেরত দিয়ে যাই। আমরা তো অবাক। এত সহজে কাজ উদ্ধার। এই না হলে পিয়ারু সরদার। চাবি ফেরত দেওয়ার প্রসঙ্গে বলি, তথাস্তু। বন্ধু আছগর মহাখুশি। কারণ সরদার সাহেব বলে দিয়েছেন, প্রয়োজনমতো সিমেন্ট বের করে নিয়ে গুদামটা ঠিকঠাকমতো তালাবদ্ধ করে রাখতে।
(এম আর মাহবুব, আহমদ রফিক, সংগ্রামে সৃজনে, অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৪)
ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক আফজালুল নেসা বলেছেন, ‘২৪ তারিখ সকাল বেলা। আমরা পাশের মহিলা হোস্টেলে থেকে টের পাইনি ব্যারাকের ছাত্ররা এমন একটি ঐতিহাসিক কাজ করে ফেলল। আমাদের হোস্টেল থেকে ২০০ গজ দূরে যেখানে ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে এবং তাতে সবাই ফুল দিচ্ছে। আমরা মেয়েরাও গিয়ে ফুল দিয়ে আসলাম। একজন সোনার চেইন খুলে দিল। সে কি দারুন উত্তেজনা!’ (আফজালুন্নেসা, বদরুল আলম, এক মহান স্থাপত্যের স্থপতি, পৃষ্ঠা, ৭১)।
যে নারী সোনার চেইন খুলে দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মা সৈয়দা খাতুন। বিষয়টি আনিসুজ্জামানের কাছ থেকেই শোনা যাক, ‘প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের (২৩ ফেব্রুয়ারি) সময়ে আমি অল্পক্ষণ উপস্থিত ছিলাম। পরদিন আবুল কালাম শামসুদ্দীন উদ্বোধন করেছিলেন বলে মনে পড়ে। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ছোট বক্তৃতা দিয়ে মোনাজাত করেছিলেন। আমার আব্বা ও মা রিকশায় করে শহীদ মিনারে গিয়েছিলেন। সকলেই শহীদ মিনারে গিয়েছিলেন। সকলেই শহীদ মিনারে টাকা পয়সা দান করেছিলেন। মা (সৈয়দা খাতুন) এক সোনার চেন দেন। চেনটি ছিল আমার মৃত একটি ছোট বোনের। তার স্মৃতি হিসেবে মা এটি রক্ষা করেছিলেন। মুর্তজা বশীরের একটি কবিতায় এই সোনার চেনটির কথা আছে। মা এটা যে শহীদ মিনারে দিয়ে আসবেন, তা আমরা কেউ জানতাম না। উনি দিয়ে এসে আমাদের বলেছিলেন।
(এম আর মাহবুব, শহীদ মিনারের ইতিহাস, অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৭, পৃষ্ঠা ৩৭)
এ বিষয়ে আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘তড়িঘড়ি করে ২৪ তারিখেই শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে উদ্বোধনের জন্য, যদিও সেটা ঠিক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছিল না এবং নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তা করা হয়নি। এই উদ্বোধনের কথা লিখেছেন সাঈদ হায়দার, অন্য সবাই তার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন মাত্র।’ এ বিষয়ে আহমদ রফিকের সাথে আলোচনায় সাঈদ হায়দার একমত হয়েছেন যে, এই প্রথম উদ্বোধন আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ছিল না। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সকালে।
তবে আনিসুজ্জামানের স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন বিষয়ক বক্তব্যটা ঠিক নয়। সম্ভবত আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আনুষ্ঠানিকভাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ মোট দুবার উদ্বোধন করা হয়েছিল। এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি অনানুষ্ঠানিকভাবে মিনারটির উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।
এ বিষয়ে আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘তড়িঘড়ি করে ২৪ তারিখেই শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয় শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে উদ্বোধনের জন্য, যদিও সেটা ঠিক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ছিল না এবং নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তা করা হয়নি। এই উদ্বোধনের কথা লিখেছেন সাঈদ হায়দার, অন্য সবাই তার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন মাত্র।’ এ বিষয়ে আহমদ রফিকের সাথে আলোচনায় সাঈদ হায়দার একমত হয়েছেন যে, এই প্রথম উদ্বোধন আনুষ্ঠানিক পর্যায়ের ছিল না। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি সকালে।
উদ্বোধনের বিষয় নিয়ে এত কথা বলার কারণ, এ সম্পর্কে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এক সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল। এমনকি এ সম্পর্কে বশীর আলহেলাল তার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নামে বইয়ে অনেক যুক্তি জাল বিস্তার করে বলতে চেয়েছেন যে, আজাদ সম্পাদক সম্ভবত শহীদ মিনার উদ্বোধন করেননি।
তাঁর ভাষায়:
‘কাজেই তিনি যে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন, এমন কথা প্রমাণ করা যাচ্ছে না, যদিও অনেকে বলেছেন তিনি এ কাজ করেছিলেন। এমন হতে পারে, ২৬ তারিখ থেকে পুলিশ ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে নতুন হামলা শুরু করেছিল, কিংবা সরকারের চাপও ছিল, তাই তাঁর ওই উদ্বোধনের ঘটনাটির সংবাদ আর ‘আজাদে’ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। কিংবা, এমন হতে পারে, উদ্বোধন করবেন এই সংবাদ আজাদের প্রকাশিত হওয়া থেকেই এই ভুল করে ধরে নেয়া হয়েছে, তিনি উদ্বোধন করেছিলেন। অবশ্য শহীদ শফিউর রহমানের পিতা যে ২৪ তারিখে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেছিলেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।’
উপরের দীর্ঘ বয়ান গভীরভাবে অনুধাবন করে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, বশীর আলহেলাল সুস্পষ্ট কোনো তথ্য ছাড়াই শুরুতে আজাদ সম্পাদক কর্তৃক শহীদ মিনার উদ্বোধনের ঘটনাটিকে নাকচ করে দিয়েছেন। এরপর সেই সম্ভাবনার ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দিকই দেখিয়েছেন এবং সবশেষে আবার নতুন কোন যুক্তি বাদেই সূচনার সিদ্ধান্তে পৌছে ধরে নিয়েছেন যে, শফিউর রহমানের পিতাই মিনার উদ্বোধন করেছিলেন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন নন।
মুশকিল হলো, শফিউর রহমানের পিতার উদ্বোধনের পক্ষে একমাত্র যুক্তি একজন ভাষা সৈনিকের সাক্ষ্য; কিন্তু শামসুদ্দীন সাহেবের পক্ষে অনুরূপ সাক্ষ্যের যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন হুমায়ুন কবির হাই, যিনি এখনো জোর দিয়ে বলেন যে, ২৬ তারিখে আবুল কালাম শামসুদ্দীন কর্তৃক মিনার উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন এবং সেই অনুষ্ঠানের আলোকচিত্র তার কাছে দীর্ঘদিন ছিল, যা একসময় ইত্তেফাকে প্রচারিত হয়। তিনি আরো বলেন, আলোকচিত্রটিতে তার নিজের ছবিও ছিল।
আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও হুমায়ূন ভাইয়ের বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। স্বভাবতই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম শামসুদ্দীন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।
(আব্দুল মতিন, আহমদ রফিক, ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৩)।
তাহলে আমরা বলতে পারি, ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ সফিউর রহমানের বাবাকে দিয়ে একবার অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারটির উদ্বোধন করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদমিনার উদ্বোধন করেন। সেদিনই সশস্ত্র পুলিশ এসে মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি শেষ বিকেলে সশস্ত্র পুলিশ এসে মেডিকেল হোস্টেল ঘেরাও করে। তিন ট্রাক ভর্তি পুলিশ সেখানে আসে। তাদের সঙ্গে ছিল গাঁইতি, বেলচা, শাবল, মোটা দড়ি, বড় বড় হাতুড়ি। ৩ নম্বর শেডের ৫ নম্বর ঘরের শরফুদ্দীন আহমদ তখন উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি দেখলেন, পুলিশ ছাত্রদের দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছে। প্রথম কয়েকবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মিনারের বুকে মোটা দড়ি বেঁধে ট্রাকের সাহায্যে হ্যাঁচকা টানে স্তম্ভটিকে মাটিতে ফেলা হয়। তারপর খণ্ড খণ্ড করে ভেঙে ট্রাকে তুলে নেওয়া হয়। কোদাল, গাঁইতি, শাবল দিয়ে চওড়া ভিত ৫ ফুট মাটির গভীর থেকে তুলে খণ্ডবিখণ্ড করে ট্রাকে তোলা হয়।
প্রথম শহীদমিনারটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দেশবাসীর মন থেকে তার স্মৃতি মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। বায়ান্ন সালে ভেঙে ফেলা হলো শহীদমিনার, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশের স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষায়তনে শহীদমিনারের মিনিয়েচার তৈরি করা হয়।১৯৫৩ সালের শহীদ দিবসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া শহীদমিনারের স্থানটিতে কালো কাপড় আর লাল কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয় প্রথম শহীদমিনারের হুবহু প্রতিকৃতি। ১৯৫৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদমিনারের (বর্তমান শহীদমিনার) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মওলানা ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা হাসিনা খাতুন।