যেখানে বঙ্গবন্ধু অনন্য | জাহীদ রেজা নূর

যেখানে বঙ্গবন্ধু অনন্য

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

জাহীদ রেজা নূর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে নেতা হিসেবে এ রকম মহিরুহ হয়ে উঠলেন, তার সবচেয়ে বড় কারণ, ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। যখন যে বিষয়ে গভীরতায় প্রবেশ করা দরকার, তখন সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। অনেকের কথা শুনে স্থির হয়ে নিজে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন। ফলে তাঁর সিদ্ধান্তগুলো হতো সুচারু।

কোনো মানুষ শুধু ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে জাতীয় নেতা হয়ে উঠতে পারেন না। তাঁকে সেই জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেক মানুষের ভালোবাসা আর শ্রম প্রয়োজন হয়। নেতা যখন উদার মনে অন্যের পরামর্শগুলো শোনেন, বিচার করেন, তখন তাঁর সামনে সবকিছু স্বচ্ছভাবে উপস্থাপিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একটা বড় গুণ ছিল, তিনি প্রথমত, মাটির কাছাকাছি ছিলেন; দ্বিতীয়ত, মাটির মানুষের কাছাকাছি ছিলেন; তৃতীয়ত, তিনি জাতীয় রাজনীতির মাঠে যে কথা বলেছেন, তা অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছে মাটি ও মানুষের কথা। এখানেই শেখ মুজিবুর রহমান অনন্য।

১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব উপলব্ধি করলেন, এনডিএফের ভেতর আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে থাকলে সংগ্রাম পরিণত হবে বৈঠকখানার বিবৃতিনির্ভর। ফলে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। বর্ষীয়ান নেতারা শেখ মুজিবের এই ভাবনাকে ভালো চোখে দেখেননি। তাঁরা এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মধ্যে থেকেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান নির্ভর করলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্বের ওপর। সহযোদ্ধা হিসেবে তিনি পেলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, কামারুজ্জামান প্রমুখকে। মনে রাখতে হবে, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স চল্লিশের ঘরে, তাঁর সঙ্গে যাঁরা আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির লাইমলাইটে এলেন, যাঁদের কথা এইমাত্র উল্লেখ করা হলো, তাঁদের বয়সও তখন চল্লিশের ঘরে। ফলে তরুণ নেতৃত্বের মাধ্যমেই যে স্বাধিকার আন্দোলনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবেন, সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনো দ্বিধা ছিল না। তিনি ছাত্রলীগের ওপরও আস্থা রাখতেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ হয়েছিলেন তাঁর অতি স্নেহভাজন।

কিন্তু ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া একেবারেই চাইছিলেন না, আওয়ামী লীগ এনডিএফ থেকে বের হয়ে পুনরুজ্জীবিত হোক। ইত্তেফাক তখন একধরনের আওয়ামী লীগের মুখপত্র। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ইত্তেফাকের সংবাদকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিবিদেরাও ইত্তেফাকের খবর দেখে আওয়ামী লীগের হৃৎস্পন্দন বুঝতে চেষ্টা করেন। মানিক মিয়ার অনীহার কারণে বিমর্ষ শেখ মুজিব চলে আসেন তাঁর কলেজজীবনের বন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেনের কাছে। সিরাজ তখন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক। সিরাজ শেখ মুজিবকে অভয় দেন। ইত্তেফাকে মুজিবের আওয়ামী লীগের খবর ছাপা হবে, সে আশ্বাস দেন। সৈয়দ শাহজাহানকে পাঠান আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের সংবাদ সংগ্রহ করতে। তাঁকে বলে দেন, তিনি যেন গোপনে রিপোর্টটি সরাসরি প্রেসে নিয়ে যান, বার্তা বিভাগে আনার প্রয়োজন নেই। মানিক মিয়ার অসম্মতির পরও সে খবর ছাপা হয় ইত্তেফাকে, সিরাজুদ্দীন হোসেনের মাধ্যমে। দুই বন্ধুর মধ্যে এই কথোপকথন এবং আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের সংবাদ ইত্তেফাকে ছাপা হওয়ার ঘটনাই বুঝিয়ে দেয়, নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ব্যাপারে কতটা দূরদর্শী ছিলেন শেখ মুজিব। মানিক মিয়াও একসময় আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন মেনে নেন। সেটাও এক বিশাল ইতিহাস।

ছয় দফা বিষয়েও মানিক মিয়া শুরুতে শেখ মুজিবের পক্ষ নেননি। লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগে বন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেনের হাতেই শেখ মুজিব দিয়ে গিয়েছিলেন ছয় দফার খসড়া। মানিক মিয়ার কান ভারী করেছিলেন বর্ষীয়ান নেতারা। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে নিয়মিত খবর ছেপেছেন বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। কীভাবে মানিক মিয়া তাঁর জনপ্রিয় কলাম ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’-এ ছয় দফার পক্ষে কলম ধরলেন, সে ইতিহাসও কৌতূহলোদ্দীপক। সেটা বলতে গেলে আলাদা একটি প্রবন্ধই লিখতে হবে।

ছয় দফা বিষয়েও মানিক মিয়া শুরুতে শেখ মুজিবের পক্ষ নেননি। লাহোরে বিরোধী দলের সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগে বন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেনের হাতেই শেখ মুজিব দিয়ে গিয়েছিলেন ছয় দফার খসড়া। মানিক মিয়ার কান ভারী করেছিলেন বর্ষীয়ান নেতারা। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে নিয়মিত খবর ছেপেছেন বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। কীভাবে মানিক মিয়া তাঁর জনপ্রিয় কলাম ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’-এ ছয় দফার পক্ষে কলম ধরলেন, সে ইতিহাসও কৌতূহলোদ্দীপক। সেটা বলতে গেলে আলাদা একটি প্রবন্ধই লিখতে হবে।

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে কে জি মুস্তাফা, এবিএম মূসা, এম আর আখতার মুকুল, তোয়াব খান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গেও সখ্য বজায় রেখে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করেছেন বঙ্গবন্ধু। সাংবাদিকদের সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তিনি বজায় রেখেছিলেন।

দুই অর্থনীতি নিয়ে যখন সরগরম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মহল, তখন ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ বলে পত্রিকাগুলোয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের যে চিত্র তুলে ধরা হয়, তা ছিল অভিনব। এই প্রচারণা বাঙালির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মূলত বাংলার মানুষ পরিণত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে। আইয়ুব খান শুরু করেছিলেন উন্নয়নের রাজনীতি। কিন্তু পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদেরা লিখছিলেন, বাংলা থেকে সম্পদ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই লাহোর প্রস্তাব থেকে যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি বারবার উঠছিল, তা যেন নতুন মাত্রা পেল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব বাংলা যেভাবে অরক্ষিত ছিল, তাতে এই অঞ্চলের মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এভাবে আর চলতে পারে না। মানুষের মনের এ কথাটিকেই মূর্ত করে তুললেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে যেভাবে এগিয়েছেন, যেভাবে তাঁদের কথা শুনেছেন, তা প্রশংসনীয়। যাঁরা পরিকল্পিত অর্থনীতি তথা দেশ গড়ার স্বপ্নের সন্ধান দিতে পারেন, তাঁদের একত্র করেছেন তিনি। রেহমান সোবহান, নূরুল ইসলাম, মাযহারুল হক, আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমানসহ সে সময়ের তীক্ষ্ণধী বাঙালি অর্থনীতিবিদদের ওপর তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন বিষয়টি বিশ্লেষণের। বঙ্গবন্ধু চাননি, কোনো বিষয়ে তাঁর অস্বচ্ছ ধারণা থাকুক। কেউ যখন ছয় দফার অর্থনৈতিক দিকটি জানতে চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু কখনো কখনো তাঁদের অনায়াসে পাঠিয়ে দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদদের কারও কাছে। কাজ ভাগ করে দিয়ে ঠিক জায়গায় ঠিক কাজটি করার এই ভাবনার ক্ষেত্রেও তিনি অনন্য।

বঙ্গবন্ধুর মধ্যে রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল, সেটি এখন খুব কম দেখা যায়। হিংসা, দ্বেষ, রেষারেষির এই যুগে বঙ্গবন্ধু আশ্চর্য ব্যতিক্রম। যারা তাঁর ওপর নির্যাতন করেছে, তাদের প্রতিও তিনি প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত হননি। লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ সম্পর্কে তাঁর যে মূল্যায়ন আমরা পাই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে, তাতে দেখা যাচ্ছে, যার যা দোষ আছে, তা উল্লেখ করার পাশাপাশি তাঁর গুণগুলোরও বর্ণনা করেছেন। রাজনীতিবিদের এই মহত্ত্ব থাকতে হয়। সবার মধ্যে না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তা ছিল। জেলখানায় দল-মতনির্বিশেষে সব বন্দীর প্রতি তাঁর সহমর্মিতার প্রকাশ দেখা যায়। শেখ মুজিবকে যে যে গুণাবলি বিশিষ্ট করেছে, তার একটি হলো তাঁর ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতাবোধ। কখনো যদি কারও কাছে তিনি উপকার পেয়েছেন, সে কথা মনে রেখেছেন এবং মন খুলে তা প্রকাশও করেছেন, পারলে তার উপকার করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর আত্মসমালোচনার কথা স্মরণ না করলে অন্যায় হবে। নিজেকে তিনি দোষে-গুণে ভরা মানুষই মনে করতেন। কাজই মুখ্য, কাজ করলে ভুল হবে, ভুল হলে তা সংশোধন করে নেব—এই ছিল মুজিবের নীতি। নিজের ভুল পদক্ষেপের কথাও তিনি স্বীকার করেছেন অকপটে।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৮০ পৃষ্ঠায় লেখাটুকু তুলে দিলে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর মনোভাব ভালো করে বোঝা যাবে, ‘আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোনো কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে যায়, কাজ আর হয়ে ওঠে না। অনেক সময় করব কি করব না, এইভাবে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোনো কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তা-ভাবনা করে যে কাজটা করব বলে ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ যারা কাজ করে, তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।’

বঙ্গবন্ধু মাটি আর মানুষের কাছাকাছি ছিলেন। সাহিত্য থেকে জীবনের পাঠ নিয়েছেন। লোকশিল্পীদের সঙ্গে মিশেছেন। সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের বুঝতে চেয়েছেন। মেধাবী নেতা আরও অনেক ছিল, কিন্তু মাটি ও মানুষের এত কাছাকাছি কেউ এভাবে পৌঁছাতে পারেননি। তাঁর হৃদয়টি ছিল অনেক বড়, পুরো দেশের মানুষের ঠাঁই হতো সেখানে। নিজেকে তিনি দোষে-গুণে ভরা মানুষই মনে করতেন, তাই নিজের চলার পথ তৈরি করার সময় রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রের মানুষের সঙ্গেই ছিল তাঁর ভাব।

তিনি সবার মধ্যে নিজেকে একজন ভাবতেন বলেই তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য।

আরও লেখা

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

শিশু ও কিশোর সাহিত্য

নীল দাড়ি

শার্ল পেরোঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক দেশে ছিল খুব বড়লোক একজন। তার ছিল সুন্দর এক

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top