মূল: ভিক্তর দ্রাগুন্স্কি
অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
আমার বয়স এখন মাত্র নয়, তারপরও আমি ভাবছি, আসলে আমাদের হোমওয়ার্কটা ঠিকভাবে করা উচিৎ। চাই কি না চাই, পছন্দ করি কি না করি, আলস্য আসে কি না আসে, তারপরও পড়া তৈরি করা খুবই দরকার। এটাই নিয়ম। আর যদি এই নিয়ম না মানা হয়, তাহলে বিপদ আসতে দেরি করে না। যেমন ধরো, কাল আমি বাড়ির কাজ করে উঠতে পারিনি। বাড়ির কাজ দেওয়া হয়েছিল নেক্রাসোভের একটি কবিতার কয়েকটা পংক্তি মুখস্ত করা আর আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর নাম মুখস্থ করা। কিন্তু আমি পড়াশোনা না করে বাড়ির উঠানো দাঁড়িয়ে একটা ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়েছিলাম আকাশে। কিন্তু ঘুড়ির লেজটা খুব হালকা হওয়ায় সেটা আর আকাশে উড়তে পারছিল না। আর তাই ওটা লাট্টুর মতো ঘুরছিল কেবল। এটা একটা কারণ।
দ্বিতীয় কারণ হলো, আমার নাটাইয়ে সুতো ছিল কম। আমি সারা বাড়ি খুঁজে যেখানে যতোটা সুতো পেয়েছি, নিয়ে নিয়েছি। মায়ের সেলাই মেশিন থেকেও সুতো খুলে নিয়েছি, কিন্তু তারপরও সুতো ছিল কম। ঘুড়িটা চিলেকোঠা অব্দি উড়ে সেখানেই ঝুলে রইল, মহাশূন্যে আর যাওয়া হলো না তার।
ঘুড়ি আর মহাশূন্য নিয়ে আমি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে পৃথিবীর আর কোনো কিছুই আমার মাথায় ঢুকছিল না। ঘুড়ি ওড়াতে আমার এতোটাই ভালো লাগছিল যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পড়া তৈরি করার কথা। কিন্তু পরে বুঝেছি, বাড়ির কাজ ভুলে গেলে দারুণ লজ্জায় পড়তে হয়।
একেবারে ঠিক বলেছেন আপনি। মিশকা! তুই কেন আমার আর রাইসা ইভানোভ্নার কথার মধ্যে ঢুকে পড়ছিস? তুই না বললেও তো আমি জানি, কাল নেক্রাসোভের কবিতা মুখস্ত করতে বলা হয়েছিল
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। যখন উঠেছি, তখন স্কুলে যাওয়ার জন্য ছিল অল্প সময়…আমি একসময় পড়েছিলাম, কত দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের লোকজন পোশাক পরে নেয়। অতিরিক্ত নড়াচড়া নেই, একবারেই ফিটফাট। আর তাতে আমি এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে গ্রীষ্মের পুরো অর্ধেকটাই আমি দ্রুত পোশাক পরার অনুশীলন করেছি। আজ যখন দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ি দেখেছি, তখনই বুঝেছি, দমকল বাহিনীর লোকেদের মতোই আজ আমাকে কাপড় পরতে হবে। এক মিনিট আটচল্লিশ সেকেন্ডে আমি স্কুলের পোশাক পরে নিয়েছি, তবে জুতোর ফিতে বেধেছি একটা ফুটো বাদ দিয়ে! সময়মতোই দৌড়ে স্কুলে চলে এসেছি, ওভারকোট রাখার ঘরটায় তখন আর কেউ ছিল না। ক্লাসটিচার রাইসা ইভানোভ্নাকে দেখলাম দূর থেকে। তিনি ঢোকার আগেই আমি দৌড়ে এসে তাঁকে ডিঙিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লাম! মানে আমি রাইসা ইভানোভ্নার চেয়ে দেড় সেকেন্ড আগে ক্লাসে পৌঁছুতে পেরেছি। এরই মধ্যে আমি ডেস্কে বইপত্র রেখেছি, মিশ্কার পাশে বসে গেছি। আমাকে দেখে মনেই হচ্ছিল না, সকাল থেকে এতকিছু ঘটে গেছে আর আমি অবশ্যই সময়মতো এসে হাজির হয়েছি স্কুলে। এরপর আমি উচ্চৈস্বরে রাইসা ইভানোভ্নাকে অভিনন্দন জানালাম, যেন তিনি বুঝতে পারেন, আমি কতোটা ভদ্র!
‘কারাবলিওফ, ব্ল্যাকবোর্ডে আয়।’ বললেন রাইসা ইভানোভ্না।
আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ আমার ঠিক তখনই মনে পড়ল, আমি বাড়ির পড়া করে আসিনি। বেঞ্চ থেকে উঠে ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একেবারেই ছিল না। মনে হচ্ছিল আমি বুঝি বেঞ্চের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছি। কিন্তু রাইসা ইভানোভ্না আমাকে দ্রুত ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে যেতে বলছেন: কারাবলিওফ! তুই কি শুনতে পাচ্ছিস না, আমি তোকে বোর্ডে ডাকছি?’
আমি ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে গেলাম। এবার তিনি বললেন, ‘কবিতা।’
মানে, যে কবিতাটা বাড়িতে মুখস্ত করার কথা ছিল, সে কবিতাটি শুনতে চাইছেন। কিন্তু আমি তো সেটা শিখিনি। আমার মনেও পড়ছিল না কোন কবিতাটা তিনি মুখস্ত করতে বলেছেন। হঠাৎ একটা ফন্দী করলাম, রাইসা ইভানোভ্না হয়তো ভুলে গেছেন, কোন কবিতাটা মুখস্ত করতে দিয়েছেন, তাই আমি যদি অন্য একটা কবিতা পড়ি, তাহলে তিনি ধরতেই পারবেন না। আমি বীরের মতো আবৃত্তি করতে শুরু করলাম,
‘শীত এসে গেছে…কুষক লেগেছে কাজে
লাকড়ি-আলোয় গড়েছে নতুন পথ
ঘোড়াগুলো আছে ধবল তুষার মাঝে
নাচ-মুদ্রায় এগিয়েছে জয়রথ।’
‘এটা পুশকিনের কবিতা।’ বললেন রাইসা ইভানোভ্না।
‘হ্যাঁ। এটা পুশকিনের কবিতা। আলেকসান্দর সের্গিয়েভিচ পুশকিনের।’ আমি বললাম।
‘আমি বাড়িতে কার কবিতা তৈরি করতে দিয়েছিলাম?’
‘হ্যাঁ।’ তড়িঘড়ি করে বললাম আমি।
‘হ্যাঁ মানে কী? জিজ্ঞেস করছি, আমি কার কবিতা মুখস্ত করতে বলেছি?’
তখন মিশকা একেবারে নিষ্পাপ মুখ করে বলল, ‘আপনি কি ভেবেছেন ও জানে না যে আপনি কাল নেক্রাসোভের কবিতা মুখস্ত করতে দিয়েছেন? ও আসলে আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি, রাইসা ইভানোভ্না।’
একেই বলে বিশ্বাসী বন্ধু। এই চালাকি করেই মিশকা আমাকে জানিয়ে দিল কবির নামটা। কিন্তু তাতে রাইসা ইভানোভ্না রেগে গেলেন। বললেন, ‘স্লোনোফ! (এটা মিশকার পদবী), খবরদার, আমাকে বোকা বানানোর মতো সাহস দেখাস না!’
আমিও নীরিহ মানুষের মতো বললাম, ‘একেবারে ঠিক বলেছেন আপনি। মিশকা! তুই কেন আমার আর রাইসা ইভানোভ্নার কথার মধ্যে ঢুকে পড়ছিস? তুই না বললেও তো আমি জানি, কাল নেক্রাসোভের কবিতা মুখস্ত করতে বলা হয়েছিল। আমি একটু ভাবছিলাম আর তার ভিতরেই কিনা তুই তোর বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিলি!’
মিশকার চেহারা লাল হয়ে গেল। ও আমার দিকে পিছন ফিরে বসে থাকল। ফলে আমাকে আবার তাকাতে হলো রাইসা ইভানোভ্নার দিকে।
‘তাহলে, বল।’ তিনি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।
‘কী?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘কী কী করবি না তো!’
বুঝতে পারছিলাম, আমি তাঁকে ক্ষেপিয়ে তুলেছি।
‘মুখস্ত বল!’
‘কী?’
‘কী আবার। কবিতাটা।’
‘ও, তার মানে আপনি আমাকে কবিতাটা মুখস্ত বলতে বলছেন। হ্যাঁ হ্যাঁ, কবিতাটাই তো পড়তে হবে। পড়ছি নেক্রাসোভের কবিতা। নেক্রাসোভ একজন মহান কবি।’
‘মানে?’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন রাইসা ইভানোভ্না।
‘মানে কী?’
‘আমি বলছি, এক্ষুণি কবিতাটা মুখস্ত বল! একেবারে শুরু থেকে বল!’ ক্ষেপে বলে উঠলেন রাইসা ইভানোভ্না।
যখন চিৎকার করে তিনি আমাকে বকছিলেন, তখন একফাঁকে মিশকা আমাকে কবিতার প্রথম শব্দটা বলে দিয়েছে। আমি তাই বুকে সাহস নিয়ে একটা পা সামনের দিকে বাড়িয়ে বললাম, ‘ছোট্ট মানুষ!’
হ্যাঁ, প্রথম শব্দ দুটো তো ঠিক আছে। ক্লাসের সবাই চুপ করে শুনছে। রাইসা ইভানোভ্নাও চুপ। কিন্তু আমি তো পরের শব্দটা জানি না। মিশকা ওর বুড়ো আঙুলের ওপর পেরেক লাগানোর ভান করছে, এ রকম একটা ইশারা করল আমাকে। আমি আবার বললাম, ‘ছোট্ট মানুষ, পেরেক ঠুকছে হাতে।’
পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। রাইসা ইভানোভ্না বললেন. ‘যথেষ্ট হয়েছে। আর দরকার নেই। যদি না জানিস, তাহলে সেটা স্বীকার করবি। এ রকম উল্টোপাল্টা বলবি না। ঠিক আছে, কাল ক্লাসে পড়া দিয়েছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের নদীগুলোর নাম মুখস্ত করে আসতে। পড়েছিস?’
আমি তো পড়িনি। ওই উড়তে না পারা ঘুড়িটাই আবার জীবনটাকে বরবাদ করে দিলো। আমি যে পড়িনি, সে কথা স্বীকার করে নিতে গিয়েও কেন যেন আমি বলে উঠলাম, ‘আমি পড়েছি নদীগুলোর নাম।’
‘তাহলে ঠিক আছে। নেক্রাসোভের কবিতা পড়তে গিয়ে যেমন সব লেজে-গোবরে করে ফেলেছিস, তাতে তো তোকে লাড্ডু দেব। এবার পারলে পাশ নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাহলে তোকে আজ রেহাই দেব। বল দেখি, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নদীর নাম কী?’
ব্যাস, আমার তো হয়ে গেছে! শরীর খারাপ করতে শুরু করেছে। পেট ব্যথা করছে। ক্লাসে একটা শব্দও নেই। কেউ কথা বলছে না। নিস্তব্ধতা। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। আমার দৃষ্টি ছাদের দিকে। আমার মনে হচ্ছিল, এবার আমি মরে যাব। বিদায় বন্ধুরা! আর ঠিক সে সময় আমি দেখলাম বাঁ পাশের একেবারে শেষ বেঞ্চিতে পেৎকা গার্বুশ্কিন বিশাল এক খবরের কাগজ মেলে ধরেছে। আর তাতে কালো কালিতে কিছু লিখেছে বড় বড় অক্ষরে। সম্ভবত আঙুলে কালি জড়িয়ে তারপর লিখেছে। কী লিখেছে এত দূর থেকে দেখে তার সবটা বোঝা যাচ্ছিল না। খুব কষ্ট করে প্রথম অংশটা পড়তে পারলাম।
আর তখনি রাইসা ইভানোভ্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমেরিকার সবচেয়ে বড় নদী তাহলে কোনটা?’
আমি গর্বের সঙ্গে বললাম, ‘মিসি-পিসি, মানে মাসি পিসি!’
এরপর কী হলো, তা নিয়ে আর কিছু বলব না। বলি কী করে! রাইসা ইভানোভ্নাই তো এমনই হাসা শুরু করলেন যে হাসতে হাসতে তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকল! কিন্তু নম্বর দেওয়ার সময় পাশ নম্বর দিলেন না। আর তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, স্কুলে যদি শিক্ষক বাড়ির কাজ দেন, তাহলে অবশ্যই সেটা তৈরি করে যাব। বুড়ো হয়ে গেলেও বাড়ির কাজ তৈরি করব। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে! এই আমার প্রতিজ্ঞা!