ফেনকা | জাহীদ রেজা নূর

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

মূল: লিওনিদ পানতালিয়েভ
অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর

তখন সন্ধ্যা। আমি ডিভানে শুয়ে শুয়ে সিগারেট ফুঁকছিলাম আর পত্রিকা পড়ছিলাম। ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। হঠাৎ শুনি,বাইরে থেকে কে যেন আঁচড় কাটছে। কে যেন জানালার কাচে খুবই মৃদু শব্দে আঁচড় কাটছে: ঠক ঠক ঠক!
‘কী হতে পারে?’ আমি ভাবতে থাকি। ‘মাছি? না, মাছি না। তোলাপোকা? না, তেলাপোকা না। তাহলে বৃষ্টির ছিটে লেগে শব্দ হচ্ছে নাকি? না, বৃষ্টিই তো পড়ছে না!’
আমি এবার অন্যদিকে তাকালাম—কিছুই দেখা যায় না। কনুইয়ে ভর দিয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম—কিছুই দেখা যায় না। কান খাড়া করলাম—নাহ্, কোনো শব্দ-টব্দ নেই।
শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই আবার ‘ঠক ঠক ঠকৃ
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। উঠে দাঁড়ালাম, পত্রিকাটা ছুড়ে ফেললাম, জানালার কাছে গেলাম এবং—কয়েকবার চোখ রগড়ালাম! ভাবলাম, এ কী দেখছি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি! দেখলাম, জানালার অন্যপাশে লোহার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে— কে দাঁড়িয়ে আছে, তুমি কি বুঝতে পারছ? দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট মেয়ে! হ্যাঁ, এমন একটা মেয়ে, যার কথা রূপকথাতেও খুঁজে পাবে না!

এক আঙুলে নামে যে গল্পটা আছে, তার চেয়েও ছোট ছিল মেয়েটি। পায়ে জুতো নেই, ফ্রকটার এখানে–ওখানে ফুটো; মেয়েটা খানিক মোটা, নাক বোতামের মতো, ঠোঁটজোড়া ছড়ানো, মাথার চুল লাল, সে চুল জুতোর ফিতের মতো এদিক-ওদিক দৌড়াচ্ছে। আমি শুরুতে বুঝতেই পারিনি যে, এটা একটা ছোট্ট মেয়ে। ভেবেছিলাম, কোনো জন্তু-টন্তু হবে। কারণ, এর আগে আমি কখনো আমার এই চোখে এত ছোট মেয়ে দেখিনি।
মেয়েটা কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দেখছে আর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জানালার কাচে আঘাত করে যাচ্ছে—ঠক ঠক ঠক।
আমি বন্ধ জানালার এ পাশ থেকে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অ্যাই ছোট্ট মেয়ে, তুমি কী চাও?’
মেয়েটা আমার কথা শুনতে পায় না। কোনো উত্তর দেয় না, শুধু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানে বলতে চায়, দয়া করে খুলে দাও, তাড়াতাড়ি খুলে দাও।
তখন আমি জানালার ছিটকিনি আলগা করে জানালা খুললাম। ছোট্ট মেয়েটাকে ঢুকতে দিলাম ঘরে।
বললাম, ‘আরে বোকা মেয়ে, জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? আমার দরজাই তো খোলা আছে!’
মেয়েটা একেবারে চিকন রিনরিনে গলায় বলল, ‘আমি দরজা দিয়ে ঢুকতে শিখিনি।’
‘মানে? জানালা দিয়ে আসতে পারো, দরজা দিয়ে আসতে পারো না?’
‘ঠিক তাই। পারি না।’ নির্দ্বিধায় বলল মেয়েটা।

‘বুঝতে পারছি, আমার ঘরে এখন ম্যাজিক কারবার চলছে!’ আমি অবাক হলাম। আমি ওর ছোট হাত ধরলাম, দেখলাম তা কাঁপছে! বুঝলাম, ভয় পাচ্ছে! জানালার দিকে তাকাচ্ছে আর কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে। মেয়েটার মুখ দেখেই বোঝা যায়, ও অনেক কেঁদেছে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠক ঠক করছে, চোখে এখনও পানি।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’
‘আমার নাম ফেনকা।’ উত্তর দিল ও।
‘ফেনকা কোত্থেকে এল?’
‘ফেনকা কোনো একখান থেকে এল!’
‘তুমি থাক কোথায়?’
‘জানি না।’
‘তোমার বাবা কোথায়, তোমার মা?’
‘জানি না।’
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, ‘তাহলে তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি কাঁপছ কেন? তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে?’
‘না, আমার ঠাণ্ডা লাগছে না। আমার খুব গরম লাগছে। আমাকে কুকুর ধাওয়া করেছিল। তাই আমি কাঁপছি।’
‘কুকুর এল কোত্থেকে?’
‘জানি না।’ মেয়েটা বলল।
তখন আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেল, আমি রেগে উঠলাম এবং বললাম,
‘শুধু জানি না জানি না বলে যাচ্ছ! তাহলে জানোটা কী? কিছু কি জানো?’
‘আমি খেতে জানি। খেতে চাই।’ বলল মেয়েটা।
‘ও, তার মানে, তুমি খেতে জানো!’
কী আর করা। আমি ওকে ডিভানে বসতে বললাম, তারপর গেলাম রান্নাঘরে। খাওয়ার মতো কিছু আছে কিনা, খুঁজে বের করতে হবে। ভাবলাম, এই আজব পুঁচকে মেয়েটা কী খাবে কে জানে! দুধ গরম করলাম, পাউরুটি কাটলাম কয়েক স্লাইস, তারপর ছোট ছোট টুকরো করে দিলাম, ঠাণ্ডা কাটলেট রাখলাম প্লেটে।

ঘরে এসে দেখি, ফেনকা নেই। কোথায় গেল মেয়েটা! ডিভানে কেউ নেই। অবাক হলাম আমি। তারপর চিৎকার করলাম, ‘ফেনিয়া, ফেনকা!’
কেউ উত্তর দিল না।
আবার আমি চিৎকার করে ডাকলাম, ফেনিয়া, ফেনকা!’
এ সময় কোত্থেকে যেন ভেসে আসে ফেনিয়ার কণ্ঠ, ‘আমি এখানে।’
দেখি, ডিভানের নিচে বসে আছে ফেনকা।
রাগ করলাম আমি। ‘আমাকে কি জাদু দেখাচ্ছ নাকি? তুমি ডিভানের নিচে গিয়ে বসে আছ কেন? ডিভানে বসোনি কেন?’
‘আমি ডিভানে বসতে পারি না।’ বলল ফেনকা।
‘কী বলছ? ডিভানের নিচে বসতে পারো, আর ডিভানের উপরে বসতে পারো না? যা ইচ্ছে তা বলে যাচ্ছ! এখন তো বলবে, খাবার টেবিলের চেয়ারটাতেও বসতে পারো না!’
‘না, এটা পারি।’
‘তাহলে খাবার টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসো দেখি।’ বললাম আমি।
খাবার টেবিলের চেয়ারে ওকে বসালাম। চেয়ারে রাখলাম একটার পর একটা বই, যেন ও একটু উঁচুতে বসতে পারে। ওর বুকে গুঁজে দিলাম রুমাল।
‘এবার খাও।’ বললাম।
বলার পরও ও খেতে শুরু করল না। দেখলাম, বসেই আছে, মাঝে মাঝে খাবার শুঁকে দেখছে নাক দিয়ে।
‘কী হলো, খাবে না? তুমি তো খেতেই চাইছিলে! খাও।’
মেয়েটা লাল হয়ে গেল। তারপর আমাকে বলল, ‘তোমার কাছে কি এরচেয়ে মজার কিছু নেই?’
‘মানে! এরচেয়ে মজা! কেমন মানুষ তুমি! অকৃতজ্ঞ! তোমাকে কি এখন চকলেট এনে দিতে হবে নাকি?’ বললাম আমি।
‘না, না। কী যে বলো। চকলেটও পচা, মজা না।’
‘তাহলে কি দেব তোমাকে? আইসক্রিম?’
‘না। আইসক্রিমও খেতে মজা না।’

‘আইসক্রিমও খেতে মজা না? তাহলে তোমাকে কী খেতে দেব, বলো তো!’
ছোট্ট মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর নাকটা একটু বাঁকিয়ে বলল, ‘তোমার ঘরে কিছু পেরেক-টেরেক হবে?’
‘পেরেক! কেমন পেরেক!’
‘এই সাধারণ পেরেক। লোহার পেরেক।’ বলল ফেনকা।
ভয় পেয়ে গেলাম আমি! আমার হাত কাঁপতে লাগল! বলে কী! বললাম, ‘তার মানে, তুমি পেরেক খাও?’
‘হ্যাঁ, আমি পেরেক খেতে অনেক ভালোবাসি।’
‘আর কী খেতে ভালোবাসো?’


‘আমি কেরোসিন খেতে ভালোবাসি, সাবান খেতে ভালোবাসি। কাগজ খেতে ভালোবাসি। বালু খেতে ভালোবাসি—তবে সেই বালু খেতে যেন মিষ্টি না হয়। তুলা খেতে খুব ভালো লাগে। ভালোবাসি দাঁতের মাজন, আঁঠা, দিয়াশলাই খেতে।’
আমি ভাবলাম, বলে কী মেয়েটা! এ কথা কি সত্য হতে পারে? সত্যিই কি ও পেরেক খায়!’
‘ঠিক আছে। পরীক্ষা হয়ে যাক!’ বলে আমি দেয়াল থেকে একটা বড় মোটা পেরেক বের করলাম, সেটাকে ভালোমতো পরিষ্কার করে ওর সামনে দিয়ে বললাম, ‘নাও, এই যে পেরেক। খাও।’
ভেবেছিলাম, এটা তো কথার কথা। মেয়েটা হয়তোবা কথা দিয়ে আমাকে ঘায়েল করতে চেয়েছে। কিন্তু আমি চোখ ফেরানোর আগেই দেখি মেয়েটা কচমচ কচমচ করে পেরেক খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। তারপর পুরো পেরেক খেয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে বলল, ‘আরো খাব।’
আমি বললাম, ‘না হে, মাফ করো আমাকে। আমার কাছে আর কোনো পেরেক নেই। যদি কাগজ খেতে চাও, আমি এনে দিতে পারি।’
‘দাও দাও, কাগজই দাও।’
কাগজ দিলাম। মেয়েটা কাগজ খেলো। পুরো এক বাক্স দিয়াশলাই দিলাম, অল্পক্ষণেই সে তা সাবাড় করে দিল। কেরোসিন ঢেলে দিলাম প্লেটে, এক নিশ্বাসে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল!
নিজের চোখে এ সব দেখলাম আর দুদিকে মাথা নাড়লাম! ‘এই মেয়েকে এখানে রাখলে কবে আমাকেই খেয়ে ফেলবে। নাহ, ওকে ঘাড় ধরে বের করে দিতে হবে, বের করে দিতেই হবে। এ রকম দানব, মানুষখেকোকে বাড়িতে রাখা যাবে না।
কেরোসিন খেয়ে প্লেটটা চেটেপুটে রেখে দিয়ে হাই তুলতে লাগল মেয়েটা। মানে ওর ঘুম পেয়েছে।

তখন ওকে দেখে সত্যিই আমার মন কেমন যেন করে উঠল। একটা চড়ুইছানার মতো জবুথবু হয়ে বসে আছে মেয়েটা, এই ছোট্ট মেয়েটাকে কী করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিই। এই রাতে ও যাবে কোথায়? আর সত্যিই তো, রাস্তায় ওকে পেলে কুকুরটা তো ওকে ছিড়েুখুড়ে ফেলবে! ভাবলাম, ‘আজ থাক। কাল ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। আজ না হয় আমার বাড়িতেই ভালো মতো ঘুমাক, শরীরটাকে বিশ্রাম দিক। আর কাল সকালে বলব, বিদায়!’
সে রকম ভেবেই ওর জন্য বিছানা ঠিক করতে বসলাম। চেয়ারের ওপর বালিশ রাখলাম, সেই বালিশের ওপর আরো ছোট একটা বালিশ। তার ওপর শুইয়ে দিলাম ফেনকাকে, কম্বলের জায়গায় একটা ন্যাকপিন দিয়ে ঢেকে দিলাম ওর শরীর।
‘এবার ঘুমাও। শুভ রাত্রি।’ বললাম আমি।
ও কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ল। একটু পরই ওর ছোট্ট নাকটা ডাকতে শুরু করল।
আমি কিছুক্ষণ বসে থাকলাম, বই পড়লাম, তারপর নিজেও ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই দেখতে গেলাম, কেমন আছে ফেনকা। এসে দেখি, চেয়ারের ওপর কিছুই নেই। ফেনকা নেই, বালিশ নেই, ন্যাপকিন নেইৃ দেখি, ফেনকা শুয়ে আছে চেয়ারের নিচে। বালিশটা ওর পায়ের নিচে, মাথাটা মেঝের ওপর, আর ন্যাপকিনৃ না, ন্যাপকিনটা দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
আমি ওকে ঘুম থেকে ওঠালাম, তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘ন্যাপকিনটা কোথায়?’
ও বলল, ‘কোন ন্যাপকিন?’
আমি বললাম, ‘সেই ন্যাপকিন, যেটা দিয়ে আমি তোমার কম্বল বানিয়েছিলাম।’
ও বলল, ‘ন্যাপকিন কোথায়, আমি জানি না।’
‘তুমি জানো না মানে?’
‘সত্যি বলছি, আমি জানি না।’ বলল ফেনকা।
ন্যাপকিন খুঁজতে লাগলাম। আমি খুঁজি, ফেনকা আমাকে খুঁজতে সাহায্য করে। খুঁজি, খুঁজি, পাই না। নাহ, কোথাও ন্যাপকিন নেই।
তখন ফেনকা আমাকে বলল, ‘শোনো, আর খুঁজতে হবে না। আমার মনে পড়েছে!’
‘কোথায় আছে ন্যাপকিনটা?’
‘আমি ভুলে ওটা খেয়ে ফেলেছি।’

খুব রেগে গেলাম আমি। মেঝেতে পা ঠুকে চিৎকার করে বললাম, ‘কেমন পেটুক তুমি! তোমার পেটে তো রাজ্যের দুর্ভিক্ষ! তুমি তো আমার বাড়িটাই খেয়ে ফেলবে!’
ফেনকা বলল, ‘আমি ভুলে খেয়ে ফেলেছি।’
‘ভুলে ন্যাপকিন খায় কী করে!’
ফেনকা বলল, ‘রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। খুব খিদে পেয়েছিল। তুমি তো খাওয়ার জন্য কিছুই রেখে ঘুমাতে যাওনি। এটা তো তোমারই দোষ।’
এরপর আর কী তর্ক করব! ছুটলাম রান্নাঘরে নাশতা তৈরি করতে। নিজের জন্য ডিম করলাম, কফি করলাম। রুটিতে মাখন লাগালাম। ফেনকার জন্য পত্রিকার কাগজ কেটে দিলাম, সাবান কেটে ছিটিয়ে দিলাম কাগজের ওপরে, তার ওপর দিলাম কয়েক ফোটা কেরোসিন। খাবার নিয়ে এলাম ঘরে, দেখলাম, আমার তোয়ালে দিয়ে ফেনকা মুখ মুছছে। প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ফেনকা বুঝি আমার তোয়ালেটা খাচ্ছে। কিন্তু পরে দেখলাম, না, খাচ্ছে না। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি পানি পেলে কোথায়?’
‘ও বলল, ‘কোন পানি?’
‘পানি মানেৃ’আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘তুমি মুখ ধুয়েছ কোথায়?’
‘আমি তো মুখ ধুইনি এখনো।’ বলল ফেনকা।
‘মুখ ধোওনি! তাহলে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছ কেন?’
‘আমি সবসময়ই তা করি। প্রথমে মুখ মুছি, তারপর মুখ ধুই।’
আর কী বলব। বললাম, ‘এবার খেতে বসো। খাওয়া–দাওয়া করে এখান থেকে চলে যাও।’
‘চলে যাব মানে?’ হতভম্ব হয়ে ফেনকা জিজ্ঞেস করল।
‘খুব সোজা! চলে যাও। তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না আমি। যত তাড়াতাড়ি বিদায় হবে, ততো ভালো। যেখান থেকে এসেছ, সেখানে চলে যাও।’
আর ঠিক তখন দেখি, ফেনকা কাঁপছে। ও আমার কাছে এসে নতজানু হলো। আমার পা জড়িয়ে ধরল, আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগল। ওর চোখে অশ্রু। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমাকে তাড়িয়ে দিও না। দয়া করে আমাকে তাড়িয়ে দিও না। তুমি যদি আমাকে আশ্রয় দাও, তাহলে তোমার অনুমতি ছাড়া একটা পেরেক, এমনকি একটা বোতামও খাব না। কথা দিলাম।’
সবাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে, এতে আমার মন গলে গেল।

তখন আমার কোনো বাচ্চা-কাচ্চা ছিল না। একাই থাকতাম। তাই আমি ভাবলাম, ‘আমাকে তো আর খেয়ে ফেলবে না। কিছুদিন আমার এখানে থাকুক। পরের কথা পরে।’
‘ঠিক আছে। শেষবারের মতো তোমাকে ক্ষমা করলাম। আমার দিকে তাকাও।’
ওর মন মুহূর্তের মধ্যে খুশিতে ভরে উঠল। ও লাফিয়ে উঠল।
তখন আমি কাজে গেলাম। কাজে যাওয়ার আগে আমি বাজার থেকে আধা কেজি ছোট পেরেক কিনলাম। ওই যে, সেই পেরেক, যা দিয়ে ঠুক ঠুক করে জুতো সারানো হয়। মুচিরা যা ব্যবহার করে। গোটা দশেক পেরেক আমি রাখলাম ফেনকার খাওয়ার জন্য। বাকিটা বাক্সে তালা দিয়ে রাখলাম।
কাজে গিয়েও আমি সারাক্ষণ ফেনকার কথাই ভেবেছি। ওর জন্য মনটা অশান্ত হয়ে রইল। কেমন আছে ও? কী করছে? আবার কোনো ঝামেলা পাকায়নি তো?’
বাড়ি ফিরে দেখি, ফেনকা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মাছি ধরছে। আমাকে দেখে ও খুশি হয়ে উঠল। হাততালি দিয়ে বলল, ‘যাক! তুমি এসেছ। কী যে খুশি হয়েছি আমি!’
‘কেন? তোমাকে কি একঘেয়েমী পেয়ে বসেছিল?’
‘হ্যাঁ, একা থাকা বড্ড কষ্ট।’
ওর হাত ধরে বললাম, ‘তোমার কি খিদে পেয়েছে?’
‘না, একট্ওু খিদে পায়নি। সকালের নাশতা থেকে তিনটা পেরেক এখনও আছে।’
তার মানে, যদি তিনটা পেরেক এখনও আস্ত থেকে থাকে, তাহলে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। তার মানে, অন্য কিছু খাওয়ার সুযোগ হয়নি। আমি ওর সদাচরণের প্রশংসা করলাম। ওর সঙ্গে একটু খেললাম, তারপর নিজের কাজ করতে বসে গেলাম।
কয়েকটি চিঠি লেখার দরকার ছিল আমার। আমি টেবিলের কাছে গেলাম। ঝরনা কলমের কালির জন্য ড্রয়ার খুললাম, দেখি, কালির দোয়াতে কালি নেই। আরে! এর মানে কী! আমি যে তিনদিন আগে এখান থেকেই কালি নিয়েছিলাম!

‘ফেনকা, এদিকে এসো।’ বললাম আমি।
‘বলো।’ বলল ফেনকা।
বললাম, ‘তুমি কি বলতে পারবে, আমার দোয়াতের কালি কোথায় গেল?’
‘কেন?’
‘এমনিই জানতে চাইছি। তুমি জান কি জানো না, সেটাই জানতে চাইছি।’
ফেনকা বলল, ‘তুমি যদি বকা না দাও, তাহলে বলব।’
‘বলো।’ বললাম আমি।
‘বকবে না তো?’
‘ঠিক আছে, বকব না।’
‘আমি কালি খেয়ে ফেলেছি।’
‘খেয়ে ফেলেছ! তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে, আমার অনুমতি ছাড়া কিছু খাবে নাৃ’
ফেনকা বলল, ‘আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, তোমার অনুমতি ছাড়া কিছু খাব না। কিন্তু আমি তো কালি পান করেছি। খাইনি। এটা তো আমার দোষ না, তোমার দোষ। তুমি কেন আমার জন্য টক পেরেক কিনেছ? টক পেরেক খেলে তো কিছু পান করতে ইচ্ছে করবেই!’
ওর সঙ্গে কথায় পারা যাবে না। বোঝা গেল, সবকিছুর জন্য দায়ী আমিই।
ভাবলাম, কী করব? বকা দেব? না, বকাবকিতে কাজ হবে না। ওকে কোনো কাজে লাগিয়ে দিলে কেমন হয়? কাজ নেই বলেই ও অলস হয়ে গেছে, আর অলস হয়েছে বলেই বোকার মতো কিছু করে ফেলে। যখন কাজের মধ্যে থাকবে, তখন বোকামী করার সুযোগ থাকবে না।
এরপর আমি ওর হাতে একটা ঝাড়ু দিয়ে বললাম, ‘শোনো, ফেনকা, আমি কাজে যাচ্ছি। তুমিও বাড়িতে কাজ করো। ঘরগুলো ঝাড় দেবে। ধুলো পরিষ্কার করে ঘরদোর ঝকঝকে তকতকে করে রাখবে। পারবে না?’
হেসে ফেনকা বলল, ‘খুব পারব। এর চেয়ে সহজ কাজ আর আছে?’
বিকেলে ঘরে এসে দেখি, চারদিকে শুধু ধুলো আর ধুলো। চারদিকে নোংরা। এদিক-ওদিক কাগজ উড়ে বেড়াচ্ছে।
‘ফেনকা!’ আমি চিৎকার করে ওকে ডাকি।

বিছানার নিচ থেকে বেরিয়ে আসে ফেনকা। ‘এই তো আমি। কী হয়েছে?’
‘তুমি ঘর ঝাড় দাওনি কেন?’
‘কেন, তা তুমি জান না?’
‘কেন, তা আমি জানি না।’ বললাম আমি।
‘কী দিয়ে ঘর ঝাড় দেব?’
‘ঘর ঝাড় দেবে ঝাড়ু দিয়ে।’
‘ঝাড়ু নেই।’
‘নেই মানে?’
‘খুব সহজ। নেই।’
‘ঝাড়ুটা গেছে কোথায়?’
চুপ করে থাকল ফেনকা। নাক দিয়ে শব্দ করল। তাতে বোঝা গেল, ঘটনা রহস্যময়!
জানতে চাইলাম, ‘খেয়ে ফেলেছ?’
‘হ্যাঁ, খেয়ে ফেলেছি।’
আমি ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। এমন দুঃখ হলো যে, রাগ করতেও ভুলে গেলাম।
তারপর বললাম, ‘দানব একটা! কী করে একজন মানুষ একটা আস্ত ঝাড়ু খেয়ে ফেলে?’
ফেনকা বলল, ‘সত্যি বলছি, কী করে এটা ঘটল, তা আমিও বলতে পারব না। এক মুহূর্তের মধ্যে কী হতে কী হয়ে গেলৃ’
‘কী আর করা!’ বললাম আমি। ‘এখন আমি কী করব? তোমার অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে কি লোহার ঝাড়ু কিনে আনতে হবে!’
‘না।’ বলল ফেনকা।
‘না মানে?’ বললাম আমি।
‘লোহার ঝাড়ুও আমি খেয়ে ফেলব।’
তখন আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর বললাম, ‘ঠিক আছে, তোমাকে নিয়ে কী করতে হবে, সেটা আমি বুঝে গেছি। কাল থেকে তুমি আমার সুটকেসে থাকবে। আশা করি, সুটকেস খাওয়ার অভ্যাস নেই তোমার!’
‘না। সুটকেসটা ধুলোয় ভরা। পরিষ্কার করে দিও, তাহলে খাব।’
‘না না, অনেক ধন্যবাদ, খেতে হবে না। ওটা থেকে ধুলো সরানো হবে না।’

পরদিন আমি ফেনকাকে বসিয়ে দিলাম আমার ছোট্ট চামড়ার সুটকেসের ভিতর। মেয়েটা কাঁদল না, চিৎকার করল না। শুধু সুটকেসের ভিতর বাতাস যেন ঢুকতে পারে, সে জন্য কয়েকটা ফুটো করে দিতে অনুরোধ করল। আমি কাঁচি দিয়ে সুটকেসে তিনটা ফুটো করে দিলাম।
এরপর থেকে ফেনকা থাকে আমার চামড়ার সুটকেসে। এরই মধ্যে ও একটু বড় হয়েছে। যখন এসেছিল, তখন ছিল বুড়ো আঙুলের মতো। এখন হয়েছে তর্জনীর সমান। সুটকেসে থাকতে ওর মোটেই খারাপ লাগছে না। বরং খুব আরামে আছে। আমি সুটকেসে এখন জানালা বানিয়ে দিয়েছি। ঘুমানোর জন্য একটা ডিভান তৈরি করে দিয়েছি। খাবার জন্য রয়েছে টেবিল। একটা ছোট্ট টেলিভিশনের জায়গাও হয়েছে সুটকেসে।
তাই, ওর জন্য কান্নাকাটি করার দরকার নেই। ও ভালো আছে। যদি কারো ইচ্ছে হয় ওকে দেখবে, তাহলে বরং আমার কাছে অতিথি হয়ে আসতে পারে। আমি অবশ্যই ফেনকার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব।

আরও লেখা

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

শিশু ও কিশোর সাহিত্য

নীল দাড়ি

শার্ল পেরোঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক দেশে ছিল খুব বড়লোক একজন। তার ছিল সুন্দর এক

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top