মূল: গেন্নাদি ৎসিফোরোভ
অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
সব ইঞ্জিনই তো ইঞ্জিনের মতো, কিন্তু একটা ছিল অদ্ভুতরকমের। এই বাচ্চা ইঞ্জিনটা সবসময় দেরি করত। সময়মতো কখনই গন্তব্যে পৌঁছুত না। একদিন তো স্টেশন মাস্টার এসে শাসিয়ে গেলেন বাচ্চা ইঞ্জিনকে, ‘আর একবার যদি দেরি করে পৌঁছাও…তাহলে তোমাকে…!’ বাচ্চা ইঞ্জিনটা তো বুঝে গেল, কী বলতে চান স্টেশন মাস্টার। তাই সে তার হুইসেল বাজিয়ে চিৎকার করে জানিয়ে দিল. ‘আ…র….হবে না… কথা…দিচ্ছি……’
শেষবারের মতো ওর কথা বিশ্বাস করলেন স্টেশন মাস্টার।
যাক! বাচ্চা ইঞ্জিন তো আবার যাত্রী নিয়ে বেরিয়ে পড়ল পথে। পথে দেখল ছোট্ট এক পাখির ছানা। খুব ইচ্ছে হলো ওর, পাখির ছানার সঙ্গে একটু কথা বলার। কিন্তু তখনই মনে পড়ল, স্টেশনমাস্টারকে সে কথা দিয়েছে, এ রকম আর হবে না। তাই ছানাটির দিকে না তাকিয়ে ও চলতে থাকল পথে। কতোটা পথ পার হলো, তা জানা নেই, এমন সময় হঠাৎ বাচ্চা ইঞ্জিনটার কানে এল বনের মধ্য থেকে ভেসে আসা পাখির গান! আহ…দীর্ঘশ্বাস পড়ল ইঞ্জিনের। একবার কিছু একটা ভাবল, তারপর সবকিছু ভুলে ট্রেনলাইন ছাড়িয়ে রওনা দিল বনের দিকে।
ট্রেনে যে যাত্রীরা ছিল, তারা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, ট্রেন ছুটেছে বনের দিকে। তারা বলতে শুরু করল, ‘কাণ্ড দেখো! আমাদের তো দেরি হয়ে যাবে!’
‘হ্যাঁ, দেরি তো একটু হবেই।’ বলল ইঞ্জিনটা। তারপর যোগ করল, ‘দেরি হলেও একসময় না একসময় তো স্টেশনে ঠিকই পৌঁছে যাব। কিন্তু আমরা যদি আজ কোকিলের গান এখানে না শুনে যাই, তাহলে তো প্রথম বসন্তের গান শোনার জন্য আরো একটা বসন্তের অপেক্ষা করতে হবে! পুরো একটা বছর দেরি হয়ে যাবে! বুঝলেন আপনারা?’
কেউ কেউ ইঞ্জিনের কথার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সবচেয়ে জ্ঞানী যে লোকটা, তিনি উপর-নিচ মাথা নাড়লেন। সম্ভবত, ইঞ্জিনটা ভুল কিছু বলছে না।
সারা রাত ধরে পুরো ট্রেনটা বনে দাঁড়িয়ে কোকিলের গান শুনল।
সকাল হলে আবার গন্তব্যের পথ ধরল বাচ্চা ইঞ্জিনটা। কতোটা পথ পার হলো জানা নেই, হঠাৎ ওর নাকে এল এক দারুণ সুগন্ধ! নিশ্বাস নেয় আর সুগন্ধ ভেসে ভেসে আসে। আর কী! ট্রেনলাইন ছেড়ে ইঞ্জিনটা রওনা দিল ফুলের বাগানের দিকে।
‘কাণ্ড দেখো! আমাদের তো দেরি হয়ে যাবে! এ তো কিছুই মানে না!’ চিৎকার করে বলতে লাগল যাত্রীরা। আমাদের তো দেরি হয়ে যাবে!’
বাচ্চা ইঞ্জিন ওদের বলল, ‘হ্যাঁ, একটু দেরি তো হবেই। কিন্তু দেরি হলেও তো আমরা একসময় স্টেশনে পৌঁছে যাব। কিন্তু আমরা যদি এখন বছরের প্রথম লিলি না দেখি, তাহলে বছরের প্রথম লিলি দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী গ্রীষ্ম পর্যন্ত!’
কেউ কেউ প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল কিন্তু সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন যিনি, তিনি বললেন, ‘ও তো ঠিকই বলছে। এখন আমরা বছরের প্রথম লিলিগুলো তুলব বাগান থেকে!’
ব্যাস! পুরো ট্রেনের মানুষ নেমে পড়ল ফুলের বাগানে। সবাই সংগ্রহ করল লিলি।
বিকেল হওয়ার পরই কেবল বাচ্চা ইঞ্জিন সবাইকে জড়ো করে আবার চলতে শুরু করল। কতোটা পথ পার হলো, জানা নেই, কিন্তু বাচ্চা ইঞ্জিনটা এরপর অনেকক্ষণ ইতিউতি চাইল না। কিন্তু যখন বাচ্চা ইঞ্জিন উঠে এল পাহাড়ি পথে, তখন হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সে।
‘এখানে কেন দাঁড়ালাম আবার?’ উত্তেজিত যাত্রীরা বলাবলি করতে লাগল, ‘এখানে তো বনও নেই, ফুলও নেই!’
‘সূর্যাস্ত দেখব এখানে!’ বলল বাচ্চা ইঞ্জিন। ‘এখন যদি আমরা এখানে পাহাড়ে কীভাবে সূর্যাস্ত হয়. তা না দেখি, তাহলে হয়তো এই জীবনে এমন সূর্যাস্ত আর দেখাই হবে না। প্রতিটা সূর্যাস্তই প্রতিটি মানুষের জীবনে একবারই আলাদাভাবে আসে!’
বাচ্চা ইঞ্জিনটার কথায় প্রতিবাদ করে, এবার অবশ্য এমন কাউকে পাওয়া গেল না। সবাই পাহাড়ের আড়ালে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখল। কেউই আর তাড়াহুড়া করল না। বাচ্চা ইঞ্জিন যতক্ষণ হুইসেল না বাজাল, ততক্ষণ পর্যন্ত সবাই সূর্যাস্ত দেখল।
এবং শেষপর্যন্ত তারা পৌঁছে গেল গন্তব্যে। যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামতে লাগল। বাচ্চা ইঞ্জিনটা স্টেশনে এসেই লুকিয়ে পড়ল। ও ভেবেছিল, যাত্রীরা নিশ্চয়ই এখন স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে।’
কিন্তু কী অবাক কাণ্ড! যাত্রীরা সবাই হাসছিল আর বাচ্চা ইঞ্জিনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল।
স্টেশন মাস্টার খুবই অবাক হয়ে যাত্রীদের বললেন, ‘বাচ্চা ইঞ্জিনটা তো আপনাদের তিনদিন পথে রেখেছে! দেরি করিয়ে দিয়েছে আপনাদের!’
‘তাতে কী হয়েছে? আমরা তো পুরো বসন্ত, পুরো গ্রীষ্ম এমন কি পুরো জীবনটাই দেরি করে ফেলতে পারতাম!’
যে পড়ল, সে নিশ্চয়ই আমার বলা গল্পটার মানে বুঝতে পারছে। আমি বলছি, কোনো বিষয়েই তাড়াহুড়ো কোরো না। যদি কোথাও সুন্দর কিছু দেখো, ভালো কিছু দেখো, তাহলে সেখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো।