জাহীদ রেজা নূর ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
বিশ্বের মানুষ হিসেবে অন্যের ভালোটাও তো নিতে হবে। তার মধ্যে মানবতার ডাক থাকলে সে ডাকে সাড়া দিতে হবে। বিশ্বায়নের জুয়াচুরিতে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, নিজের অস্তিত্বকে জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না, সেটা ঠিক। কিন্তু বিশ্বের সেরা জিনিসগুলোর সংমিশ্রণে নতুন কিছু আমরাইবা কেন তৈরি করব না? বহতা নদীর মতো যদি হয় ভাষা, তাহলে সেই স্রোতটা ভাষার পরতে পরতে ছড়িয়ে যাওয়া তো খুবই জরুরি।
আমাদের একটা অসাধারণ গুণ আছে। যেকোনো সংকটকে নানা যুক্তি দিয়ে অগ্রাহ্য করতে পারি। সাদা চোখে দেখতে পাই, সংকট রয়েছে। কিন্তু কাগজ–কলমে প্রমাণ করে দিতে পারি—এই সংকট আসলে ধোঁয়াশা।
এর বড় একটা কারণ হলো, প্রশ্নটির সামনে দাঁড়িয়ে গায়ের জোরে সংকটটি বুঝতে চাওয়ার অনীহা এবং স্রোতে গা ভাসিয়ে চলার পথটিকে মসৃণ রাখার চেষ্টা করা। ভাষাবিষয়ক প্রশ্নগুলোর মধ্যে যে সংকট জাজ্বল্যমান, সেগুলো এড়িয়ে কেবল স্তুতি আর অমরতার মন্ত্র জপলে সাধারণ্যে ভাষাপ্রেম পোক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো কাজ হয় না।
এই স্বল্পপরিসর লেখায় ভাষা প্রসঙ্গ নিয়ে অল্প কিছু কথা বলব।
১. নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসার অর্থ যে ভিন্ন ভাষাকে অবজ্ঞা করা নয়, সে কথা আমরা অনেকেই বুঝি না। পাকিস্তান রাষ্ট্রে যখন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন এল, তখন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মানুষ কী চেয়েছিল? তারা রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে চেয়েছিল। তারা উর্দুকে অগ্রাহ্য করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ উর্দু ভাষায় যেমন স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তেমনি পূর্ববঙ্গের মানুষের গভীরতা ছিল বাংলা ভাষায়। ফলে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গটিতে উর্দুর পাশাপাশি বাংলার কথা অনায়াসেই এসে পড়ে।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যৌক্তিকভাবেই বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারত ক্ষমতায় আসীন মুসলিম লীগ। কিন্তু তারা এক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। পত্র-পত্রিকায়, বিভিন্ন বইয়ে বাংলার সপক্ষে যে প্রচার চালাতে হয়েছিল, তাতে সন্নিবেশিত হয়েছিল বহু ভাষাভাষী দেশের অভিজ্ঞতা। সরকার সেগুলো আমলে নেয়নি। এমনকি, বাংলা মুসলিম লীগের অভিজাতশ্রেণির প্রতিনিধিরাও বাড়িতে উর্দুভাষী ছিলেন বলে সারা বাংলার সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলাকে আমলে নেননি। জিন্নাহর সঙ্গে যখন তারা কথা বলতেন, তখন ইংরেজি বা উর্দুই ব্যবহার করতেন।
এই সমস্ত কিছুরই ফল, ১৯৪৮ সালের ২১ ও ২৪ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স আর কার্জন হলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণা এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি শিক্ষিত মানুষের মনে ভাষা–প্রশ্নটির দৃঢ় ভিত্তি পাওয়া।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ধর্মঘটে ছাত্র–শিক্ষকদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একটা চুক্তিও করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি সে চুক্তির শর্তগুলো আর মানেননি। ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে জিন্নাহ নিজেও বাংলা ভাষার প্রশ্নটিকে ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে, কমিউনিস্টদের সঙ্গে জড়িয়ে লঘু করার চেষ্টা করেছিলেন। ফল হয়েছিল, বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা আরও পোক্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রশ্নটিকে সুদৃঢ় করার শক্তি অর্জন করেছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
ইতিহাস লিখতে চাইছি না। সেটা ভাষা আন্দোলন-বিষয়ক যেকোনো বইতেই পড়ে নেয়া যাবে। আমি শুধু এখানে বলতে চাইছি, বাঙালিরা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষার যে অঙ্গীকার করেছিল, বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে ভাষা প্রসঙ্গটির আলোড়নেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল পরে, তার একটা মানে আছে। সেই ‘মানে’টা নিয়েই কিছু বলতে চাইছি।
ইতিহাস লিখতে চাইছি না। সেটা ভাষা আন্দোলন-বিষয়ক যেকোনো বইতেই পড়ে নেয়া যাবে। আমি শুধু এখানে বলতে চাইছি, বাঙালিরা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষার যে অঙ্গীকার করেছিল, বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে ভাষা প্রসঙ্গটির আলোড়নেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল পরে, তার একটা মানে আছে। সেই ‘মানে’টা নিয়েই কিছু বলতে চাইছি।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের মধ্যেই সুপ্ত ছিল সকল ভাষার মর্যাদার অঙ্গীকার। অর্থাৎ, বাংলা নামের দেশে যে ভাষাগুলো রয়েছে, সেই ভাষাগুলো থাকবে মর্যাদার আসনে, এটা ছিল একটি লক্ষ্য।
অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন কোনোভাবেই অন্য ভাষার প্রতি বিদ্বেষমূলক আন্দোলন ছিল না। বাংলা ভাষাকে তার যোগ্য আসনে বসিয়ে সকল ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনই ছিল তা।
২. একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারে ফুল দেয়ার একটা মানে আছে। সেটা হৃদয়ের অন্তস্তলের আলোড়ন এবং রীতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা চেতনার প্রকাশ। কিন্তু বাংলা ভাষার উন্নয়নকল্পে আমাদের পরিকল্পনাগুলো পালিত হচ্ছে কি না, সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এটি তো শুধু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে শব্দের কথামালা প্রকাশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।
উচ্চশিক্ষার মাধ্যম এখনো ইংরেজি। এ নিয়ে কথা বলার আগে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। আইনজীবী সামসউদ্দিন আহমদ ১৯৬৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্টের সনদ লাভের জন্য বাংলায় দরখাস্ত করেছিলেন। হাইকোর্টে বাংলা অচল—এই কথা বলে এই দরখাস্তের ভিত্তিতে সনদ মঞ্জুর করা যাবে না, এ কথা তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সামসউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করার কোনো অধিকার বার কাউন্সিলের নেই। ইংরেজিতে দরখাস্ত লিখতে বাধ্য করতে পারে না। ১৯৬৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকা হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় একটি ফৌজদারি রিভিশন দাখিলের চেষ্টা করেছিলেন তিনি।
এ তথ্যগুলো জেনেছি ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক ও বিচারপতি কাজী এবাদুল হকের লেখা থেকে। কিন্তু এরপর কী হয়েছিল, সেটা জানা হয়ে ওঠেনি।
আমরা গর্ব করতে পারি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলা ভাষায় লিখিত প্রথম সংবিধান নিয়ে, ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় প্রথম ভাষণ নিয়ে, কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের বিষয়টি এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
আমাদের উচ্চ আদালত, আমাদের উচ্চশিক্ষায় এখনো ইংরেজিই স্বচ্ছন্দ ভাষা। এর একটা বড় কারণ, বাংলাকে সেই মর্যাদা আমরা দিতে পারিনি, যে মর্যাদার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। পৃথিবীর বহু দেশ তাদের নিজের ভাষাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে সমীহ সৃষ্টিকারী অবস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছে নিজের দেশকে। ফরাসি, রুশ, জাপানি, চীনাসহ অনেক ভাষাই সে মর্যাদা লাভ করেছে। নিজ ভাষায় সুদক্ষ হয়ে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে অন্য একটি ভাষা (আমাদের ক্ষেত্রে সেটা ইংরেজি) শিখে নেয়ার মধ্যে কোনো সংকট থাকতে পারে না। কিন্তু নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করে দ্বিতীয় ভাষা ব্যবহারে গর্বিত হলে নিজের ভাষা কখনোই গর্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
৩.
১৯৪৭ সালের দেশভাগের ফলে বাংলার মূল কেন্দ্র কলকাতা পূর্ববঙ্গের বাইরে পড়ে। এই অঞ্চল থেকে হিন্দু জমিদাররা তাদের সম্পত্তি নিয়ে কলকাতায় চলে যান, ব্যবসায়ীরাও চলে যান ভারতে। ভারতের ধনাঢ্য মুসলিমরা চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। ভূমিনির্ভর ধনাঢ্য মুসলিমরা বাস করত পশ্চিম পাকিস্তানেই। অর্থাৎ সেখানে মুসলিমরাই ছিল সামন্ত প্রভু। মুসলিম লীগের মূল নেতৃত্বেও ছিল তারাই। অচিরেই বোঝা গেল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিরা পড়বে অসুবিধায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে পূর্ব বাংলায় সরকারি চাকরিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল। দেশ বিভাগের পর অধিকাংশ হিন্দু কর্মকর্তা-কর্মচারী চলে যান ভারতে। সে সময় ইংরেজ আধিপত্যেরও অবসান হয়। কিন্তু দেশ বিভাগ কার্যকর হওয়ার পর শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, চাকরির ক্ষেত্রেও উদুর্ভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা বাঙালিদের চেয়ে উন্নততর, এ রকম মনোভাব তাদের আচরণে প্রকাশ পায়। স্বভাবতই চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাঙালি সুবিচার পাবে না, এই আশঙ্কা বাঙালি সমাজে ঘনীভূত হয়। তাই ভাষার প্রশ্নটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে প্রগাঢ় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
এই বাস্তবতাটুকু মনে রাখলেই বোঝা সহজ হবে, কেন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার দিকে জোর দিচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে কেন আন্দোলনের দরকার হলো।
৪.
এবার আমরা একটু পিছনের দিকে তাকাই। ভাষা-বিতর্কে সে সময় কোন কোন যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছিল, তার কিছুটা দেখার চেষ্টা করি।
আব্দুল হক, মুসলিম জাতীয়তাবাদ পুনর্নিরীক্ষা প্রবন্ধে বাংলা ও উর্দুর ব্যাপারটি পরিষ্কার করছেন এভাবে-
‘প্রথমত, ভাষা ও সাহিত্যের কথাই ধরা যাক। পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মুসলমানদের ভাষা কি এক? কেউ বলবেন না যে এক, কিন্তু তথাপি জিন্নাহ সাহেব কেন সে কথা বলেছিলেন তা এখন সঠিকভাবে নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। এর কারণ সম্ভবত এই যে, তার ধারণা ছিল বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা, মুসলমানদের নয়। তিনি বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে থাকবেন, কিন্তু সম্ভবত নজরুল ইসলামের কথা শোনেননি। কিন্তু এ ব্যাপারে একা তার উপর দোষারোপ করা নিরর্থক।
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় স্বয়ং ‘বাবায়ে উর্দু’ ডক্টর আব্দুল হকের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও বলেছিলেন যে, ‘বাংলা ভাষা পৌত্তলিক হিন্দুদের ভাষা।’ অধিকন্তু বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেবের ধারণা গড়ে উঠেছিল প্রধানত বাংলার সেইসব নেতার সংস্পর্শে, যারা বাংলার অধিবাসী হয়েও বাঙালি ছিলেন না। যারা বাঙালি ছিলেন, তারাও নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলতেন হয় উর্দুতে, নয় ইংরেজিতে।…
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় স্বয়ং ‘বাবায়ে উর্দু’ ডক্টর আব্দুল হকের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিও বলেছিলেন যে, ‘বাংলা ভাষা পৌত্তলিক হিন্দুদের ভাষা।’ অধিকন্তু বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে জিন্নাহ সাহেবের ধারণা গড়ে উঠেছিল প্রধানত বাংলার সেইসব নেতার সংস্পর্শে, যারা বাংলার অধিবাসী হয়েও বাঙালি ছিলেন না। যারা বাঙালি ছিলেন, তারাও নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলতেন হয় উর্দুতে, নয় ইংরেজিতে।…
অতএব, পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের ভাষা যে বাংলা এবং তারা বাঙালি— এ ধারণা হয়তো তার মনে স্পষ্ট ছিল না।
…“কিন্তু জিন্নাহ সাহেব যা-ই বলে থাকুন, বাঙালি মুসলমানেরা বাঙালি এবং তাদের ভাষা বাংলা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা তা নয়। দুই প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা যেমন এক নয়, তেমনি তাদের সাহিত্য এবং সাহিত্যের ঐতিহ্যবোধও এক নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাহ আব্দুল লতিফ ভিট, ওয়ারিশ শাহ, খোশহাল খান খটককে আমরা কতটুকু জানি? এমনকি ইকবালের রচনাবলি মূল ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পূর্ব-পাকিস্তানের কজন আমরা পড়ব? তাদের রচনাবলি মূলে বা অনুবাদে এ প্রদেশে চর্চিত প্রদর্শিত হতে পারে, কিন্তু মূলত তারা পশ্চিম পাকিস্তানি। তেমনি দৌলত কাজী, আলাওল থেকে শুরু করে আজ অবধি যে মুসলিম সাহিত্য, অথবা পূর্ববঙ্গ গীতিকা, পুথি সাহিত্য, বাউল, জারি, সারি, ভাটিয়ালি গানে পুষ্ট সমৃদ্ধ পূর্ব-পাকিস্তানের যে গণসাহিত্য ধারা, যা একান্তভাবে প্রদেশের সত্তায় ও চেতনায় মিশে আছে, মূলে বা অনুবাদে তার কতটুকু আস্বাদ নিতে পারবেন পশ্চিম-পাকিস্তানী পাঠক? এই সাহিত্য একান্তভাবে পূর্ব-পাকিস্তানের। অতএব এক জাতিত্বের দুটি প্রধান লক্ষণ—ভাষা ও সাহিত্যের একাত্মবোধ—এই দুই প্রদেশের অধিবাসীদের নেই।…
… কিন্তু অন্যান্য সচেতন ব্যক্তিগণ অবহিত যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি এক নয়। সদৃশ সংস্কৃতি বিকাশের অপরিহার্য শর্ত যে দৈশিক সংলগ্নতা এবং একই ভৌগোলিক পরিবেশ, ভৌগোলিক প্রকৃতি এবং ভাষা ও সাহিত্য, তা দুই প্রদেশে অনুপস্থিত। কি করে বলা সম্ভব যে, এ রাষ্ট্রের পশ্চিমাংশের মরুরুক্ষ, পর্বত সংকুল, গ্রীষ্ম দগ্ধ ও তুষারশীতল পরিবেশের জীবনধারা এবং পূর্ব অংশের নদীবহুল বর্ষণমুখর ঘন শ্যাম-সবুজ সমতল পরিবেশের জীবনধারা ঠিক একরকম, অতএব এই দুই ভূভাগের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার, জীবনবোধ এবং সংস্কৃতি একদম এক বস্তু? পশ্চিম পাকিস্তানের খটক লুড্ডি ঝুমুর নাচ, পূর্ববঙ্গের চাকমা মনিপুরী সাঁওতালি নাচ, যাত্রা ও কবিগান, পশ্চিম পাকিস্তানের চুঘতাই ফৈজি রাহামিনের চিত্রশিল্প এবং পূর্ববঙ্গের জয়নুল আবেদীন, সফিউদ্দিন, কামরুল হাসানের চিত্রশিল্প কি এক বস্তু? হিজরী অব্দ দুই পাকিস্তানেই প্রচলিত, কিন্তু তেমনি প্রচলিত খ্রিস্টাব্দও, কিন্তু বাংলা অব্দ বর্তমানে একান্তভাবে পূর্ববঙ্গের।”
(আব্দুল হক, মুসলিম জাতীয়তাবাদ পুনর্নিরীক্ষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী সংস্করণ ২০১৭, পৃষ্ঠা ৪৮- ৫৫)।
‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ প্রবন্ধে মাহবুব জামাল জাহেদী কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া উচিত, তা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ পত্রিকায়, ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই।
সে প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি বলেন-
“হৃতগৌরব ফিরিয়া পাইবার জন্য বাংলার মুসলমান চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে; ইহার প্রভূত প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। এই দিক হইতে বিচার করিলে কিছুকাল পূর্বে উর্দু ভাষার কোন দাবিই খাটিত না। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা বিপর্যয়ের সুযোগ গ্রহণ করিয়া ওই ভাষাভাষীরা তাহাদের দাবিকে শক্ত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বিচার করিলে ইংরেজি ভাষার দাবি অবশ্যই অগ্রগণ্য, কারণ এতদিন রাজনীতি ক্ষেত্রে ইংরেজীরই প্রাধান্য ছিল। তবে বৈদেশিক কোন ভাষা পাকিস্তানের কোন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ভাষা হতে পারে না— এইজন্যই ইংরেজির দাবি মানিয়ে লওয়া যায় না। সুতরাং উর্দু এবং বাংলার দাবী মাত্র এখন আমাদের বিচার্য। কিন্তু উর্দুও যে প্রকৃতপক্ষে এই দেশীয় ভাষা—এই কথাও বলা চলে না। উর্দু হইল তুর্কি শব্দ মানে ‘শিবির’। সৈন্যদের মধ্যে আলাপ আলোচনার সুবিধার্থে সম্রাট আকবর এই ভাষার উদ্ভাবন করেন—শিবিরজাত বলিয়াই এই ভাষার এই নাম। সুতরাং দেখা যাইতেছে, উর্দু ভাষা প্রকৃতপক্ষে দেশের ভাষা নয়। বিভিন্ন দেশীয় শব্দ সম্ভার হইতে চয়ন করিয়া এই ভাষার শব্দসম্ভার সমৃদ্ধশালী করা হইয়াছে। স্বকীয়তা বলিতে এই ভাষার কিছুই নাই। এই ভাষার দাবি অগ্রগণ্য হইতে পারে না।
আবার অনেকে এই ভাষাকে মুসলমানি ভাষা হিসেবে দাঁড় করাইয়া ইহাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাইতে চেষ্টা করিতেছেন। এই প্রচেষ্টা যে নিতান্তই ভাবপ্রবণতা, একথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। কারণ, প্রথমত, মুসলমানি ভাষা বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ভাষার অস্তিত্ব নাই। তাহা হইলে মুসলমানগণ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাকেই মুসলমানি ভাষা বলা যাইতে পারে। ইহা হইতে পারে যে, ইসলামের শিক্ষা সংস্কৃতি যে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহাকেই মুসলমানি ভাষা বলা চলে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মতে আরবি ভাষাকেই একমাত্র মুসলমানি ভাষা বলা যাইতে পারে। সুতরাং মুসলমানি ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, এই যুক্তি বলে আরবি ভাষাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করিতে হয়। কিন্তু তাহার ফল কি হইবে, উহা সহজেই অনুমান করা যায়। তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, ইসলামের ঐতিহ্যকে বহনের দাবিতে রাষ্ট্রভাষা হইবার যোগ্যতা বাংলার নাই উর্দুরও নাই, তবে পূর্ব প্রদর্শিত কারণে উর্দু হইতে বাংলার দাবি বেশি যুক্তিসংগত।”
(মাহবুব জামাল জাহেদী, ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’, ইত্তেহাদ, ২০ জুলাই, ১৯৪৭ )
৫.
আসলেই ভাষার লড়াইটা কোন কোন বিষয়ে কীভাবে আবর্তিত হচ্ছিল, সে সম্পর্কে একটু ধারণা দেয়ার জন্যই দীর্ঘ দুটি উদ্ধৃতি দেওয়া হলো এখানে। ভাষা প্রসঙ্গটি বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে তার সংকটগুলোও অনুধাবন করা সহজ হয়।
বর্তমানে যে সকল কারণকে ভাষার প্রতি অসম্মান বলে আমরা চিহ্নিত করি, সেগুলো আসলে খুবই গৌণ বিষয়। আসল সমস্যা হচ্ছে, সত্যিকার অর্থে ভাষার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা, ভাষার প্রতি সম্মানে অপারগতা, ভাষাকে বহতা নদীর মতো বয়ে যেতে দিতে অনীহা।
এর শুরু কিন্তু বাড়িতেই। শৈশবকাল থেকেই দেশপ্রেমের শিক্ষা দেয়া না হলে ভাষাপ্রেমও হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠে না। ২১ ফেব্রুয়ারিও তখন যেকোনো রিচুয়ালের মতো একটি ঘটনা বলে মনে হয়। এরপর স্কুল-পর্যায়ে দেশ ও নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে নানাভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যে মমতা ও ভালোবাসা নিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হয়, আমাদের দেশের শিক্ষকদের একটা বড় অংশই সেটা করেন না। পড়াশোনা প্রতিযোগিতার ব্যাপার হয়ে তা আর জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে থাকেনি, হয়ে গেছে যান্ত্রিক সফলতার নির্ণায়ক। ওয়াইফাই, মোবাইল ফোন ইত্যাদির বদৌলতে মানুষ সমাজবিচ্ছিন্ন থাকতে পারছে। আশপাশে কী হচ্ছে, তা তাকে স্পর্শ করছে না। আবেগ ও অনুভূতি বলে আমরা যেসব মৌলিক জায়গাকে চিহ্নিত করতাম, তা পরিবর্তিত হয়েছে নতুন প্রজন্মের অনেকেরই কাছে। ফলে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টিও পাল্টে গেছে। সেইসঙ্গে নতুন নতুন জ্ঞান–বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আগের প্রজন্মের ভুলগুলো দেখে একধরনের অশ্রদ্ধাও ভর করেছে অনেকের মনে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটায় নৈতিকতার চর্চা কমে গেছে কিনা, তা নিয়েও অনেকে ভাবছেন। অনেকেই মনে করছেন, অতি দ্রুত সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় লাগবে। এই সংকট গোটা দুনিয়ার। বাংলাদেশও সেই অনিশ্চয়তার দোলাচলের একটি অংশমাত্র।
এবার বলি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার কথা। আসলে স্নাতক পর্যায়ে নিজভাষায় পড়াশোনা করার সুযোগ নেই বললেই চলে। এখন শিক্ষক যে ক্লাস নেন, সেই ক্লাসে দেওয়া বক্তৃতার পর শিক্ষার্থী লাইব্রেরিতে গিয়ে আরও অনেকগুলো বই থেকে বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানবেন, সে বিষয়ে সুদক্ষ হয়ে উঠবেন। এমনই হওয়ার কথা। আমাদের দেশে বাংলায় উচ্চশিক্ষা-বিষয়ক বই কি আছে? আমরা সে সুযোগই তো রাখিনি। শিক্ষক শিক্ষার্থীর জ্ঞানচর্চার পথ দেখান। বাংলা ভাষায় সেই পথ আজও রুদ্ধ।
৬.
অনেকেই বলেন, হিন্দি সিরিয়ালে দেশ ছেয়ে গেল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বস্তাপচা সিরিয়ালের দিকেই টিভি-দর্শকের চোখ, সিনেমা দেখার কথা উঠলেও হলিউড–বলিউড–ফরেনফিল্ম, কোরিয়ান ছবি, ইরানি ছবির প্রতি দর্শকের পক্ষপাত—এই এলাকায় বাংলা কোথায়? এফএম রেডিওর ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’ এখন জাতীয় সম্বোধন হয়ে উঠেছে। এর কি কোনো মানে আছে?
আছে। মানে আছে। মানে হলো এই যে, আমরা আমাদের দেশবাসীর কাছে আকর্ষণীয় কিছু পৌঁছে দিতে পারছি না। আমরা এমন কিছু (ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে) পৌঁছে দিতে পারছি না, যা তাকে হিন্দি, কলকাতাইয়া সিরিয়াল থেকে দূরে রাখবে। এমন কোনো চলচ্চিত্র তৈরি করছি না, যা দেখার জন্য অবাক হয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এটা শুধু দর্শকের হীনম্মন্যতা ভাবলে ভুল হবে। আমরা আমাদের মানসম্মতভাবে তৈরি করতে পারছি না।
যে উদাহরণটি দেব, সেটা অনেকের পছন্দ না–ও হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করি বলে তা বলব। ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলের যেসব রিয়ালিটি শো হয়, তার মান দেখুন। সেখানে যারা অংশ নেন, তাদের চর্চা ও পরিশ্রম দেখুন, এরপর সে সব রিয়ালিটি শোয়ের অনুকরণে (সোজা বাংলায় নকল) যেসব রিয়ালিটি শো তৈরি হচ্ছে, সে সবের মান কোন পর্যায়ের, সেটা দেখুন। আপনার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা মানের চেয়ে যেনতেন প্রকারে নকলবাজ হয়ে টিআরপি বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি। মননশীল আর সৃজনশীল কাজে আত্মমগ্ন হয়ে পরিশ্রমলব্ধ খাঁটি জিনিস উপহার দেওয়াটাই মুখ্য। কিন্তু অনুকরণে সে প্রসববেদনা নেই। ছাঁচে ঢেলে দিলেই হলো।
পরিশ্রম করব না, গালাগাল করব অন্যকে— তা দিয়ে কি নিজের মান রাখা যায়?
আরও কথা আছে। বিশ্বের মানুষ হিসেবে অন্যের ভালোটাও তো নিতে হবে। তার মধ্যে মানবতার ডাক থাকলে সে ডাকে সাড়া দিতে হবে। বিশ্বায়নের জুয়াচুরিতে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না, নিজের অস্তিত্বকে জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না, সেটা ঠিক। কিন্তু বিশ্বের সেরা জিনিসগুলোর সংমিশ্রণে নতুন কিছু আমরাইবা কেন তৈরি করব না? বহতা নদীর মতো যদি হয় ভাষা, তাহলে সেই স্রোতটা ভাষার পরতে পরতে ছড়িয়ে যাওয়া তো খুবই জরুরি।
৭.
অনেকদিক ঘুরেও যে জায়গার নাগাল পাওয়া গেল না, সেটা হলো, পরিশ্রম ও সদিচ্ছার মাধ্যমে যদি পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে আমরা হয়তো ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে পারব। নিজের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা, অন্যান্য দেশের ভাষা, অবলুপ্ত হওয়ার পথে থাকা ভাষাগুলোর ব্যাপারে মনোযোগী হতে পারব।
বাংলা ভাষায় চিন্তাচর্চা ও সৃজনশীলতার চর্চা বাড়াতে হবে। বই-পত্র (ডিজিটালসহ) লেখালেখি বাড়াতে হবে। ভাষাকে হাজির করতে হবে তার সমস্ত মাধুর্য দিয়ে। সে কাজটা করতে পারেন তিনিই, যার রয়েছে অগাধ পড়াশোনা, নতুনের সঙ্গে পুরনোকে মেলানোর শক্তি, বাংলায় নিজেকে প্রকাশ করার অনায়াস ক্ষমতা। আরও অনেক গুণাবলি নিশ্চয়ই রয়েছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা হতে হবে।
নিজের দিকে তাকানো ছাড়া এবং তাকিয়ে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে করণীয় ঠিক করে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আপাতত মুক্তি নেই।