ভিক্তর দ্রাগুন্স্কি
রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
আমার বয়স যখন ছয় বা সাড়ে ছয় হলো, তখনও জানতাম না বড় হয়ে আমি কী হব। চারপাশের সব মানুষকে আমার ভালো লাগত, সবধরনের কাজ ভালো লাগত। আমার মাথায় আমি সব লেজেগোবরে করে ফেলেছিলাম, তাই মাঝে মাঝে উদাসীন হয়ে যেতাম, বুঝতে পারতাম না, আমি কোন কাজের যোগ্য।
কখনো আমার ইচ্ছে হতো জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলে রাতে না ঘুমিয়ে সারারাত টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে তাকিয়ে থাকা যেত অনেক দূরের তারার দিকে। কিংবা আমার মনে হতো, হয়ে যাই জাহাজের ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন হয়ে চলে যাওয়া যেত অনেক দূর—সিঙ্গাপুর। দুই পা দুদিকে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেত সারেং–এর ঘরে। তারপর সুদূর সিঙ্গাপুর থেকে কিনে আনা যেত দারুণ এক বাঁনর! কখনো আমার ইচ্ছে হতো মেট্রোর চালক হওয়ার। কিংবা হতে ইচ্ছে করত স্টেশনের প্রধান হতে। তাহলে লাল জামা গায়ে দিয়ে চিৎকার করে বলতে পারতাম, ‘প্রস্তুত!’
মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হতো সেই শিল্পীর মতো হতে, যিনি গাড়ি যে রাস্তায় চলে, সে রাস্তায় সাদা সাদা জেব্রা ক্রসিং আঁকেন। কখনো মনে হতো আলেন বোমবারের মতো পরিব্রাজক হলে ভালো হয়, সবগুলো মহাসাগর ঘুরে আসা যেত তাহলে! ভ্রমণের পুরোটা সময় খেতে হতো কাচা মাছ! অবশ্য এই বোমবার তার ভ্রমণ শেষে যখন ফিরে এলেন, তখন তার ওজন কমে গিয়েছিল ২৫ কিলোগ্রাম! আর সবমিলে আমার ওজনই ছিল তখন মাত্র ছাব্বিশ কিলোগ্রাম। তাই ভাবলাম, আমি যদি ওর মতো পরিব্রাজক হই, তাহলে ভ্রমণ শেষে যখন বাড়ি ফিরব, তখন আমার ওজন কমতে কমতে হবে এক কিলোগ্রাম! আর যদি এমন কোথাও গিয়ে পৌছাই, যেখানে কাচা মাছ পাওয়া যায় না। মাছ পাওয়া না গেলে আমার তো ওজনই থাকবে না! আমি স্রেফ ধোঁয়ায় পরিণত হয়ে মিলিয়ে যাব বাতাসে। এই হলো ব্যাপার।
যখন এতকিছু ভেবে নিয়েছি, তখন হঠাৎ মনে হলো, আমি আসলে মুষ্টিযোদ্ধা হব। সে সময় আমি টেলিভিশনে মুষ্টিযুদ্ধে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ দেখছিলাম। একে অন্যকে কীভাবে যে মারছিল! মারাত্মক ব্যাপার।
এরপর একবার তাদের প্রশিক্ষণের খবর দেওয়া হলো টেলিভিশনে। সেখানে দেখা গেল কালো বিশাল বালিশের মতো ঝুলন্ত একটি বস্তুতে জোরে ঘুষি মারছে মুষ্টিযোদ্ধারা। (রুশ ভাষায় এটাকে বলা হয় নাশপাতি)। খুব জোরে জোরে এই নাশপাতিতে ঘুষি মারতে হয়। আমার মনে হলো, আমাকে মুষ্টিযোদ্ধা হতে হবে। আমি হব আমাদের পাড়ার শক্তিশালী মানুষ। সবাইকে হারিয়ে আমিই সেরা হব।
‘বাবা, আমাকে নাশপাতি কিনে দাও।’
‘এটা জানুয়ারি মাস। এখন নাশপাতি নেই। বরং গাজর খা।’
‘না না। আমি ফলের কথা বলিনি। তুমি আমাকে মুষ্টিযোদ্ধার সাধারণ নাশপাতি কিনে দাও।’
‘সেটা দিয়ে তুই কী করবি?’ বাবার মনে কৌতুহল।
‘প্র্যাক্টিস করব।’ বললাম আমি। ‘আমি বক্সার হব। সবাইকে হারিয়ে দেব। কিনে এনো।’
‘ওই নাশপাতির দাম কতো?’
‘কতো আর হবে, দশ রুবল বা পঞ্চাশ রুবল!’ বললাম আমি।
‘তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’ বলল বাবা। ‘নাশপাতির দরকার নেই। কিছু একটা খুঁজে নিয়ে তার ওপর প্র্যাক্টিস চালিয়ে যা।’ এই কথা বলে বাবা কাপড় পরে চলে গেল অফিসে।
বাবার ওপর আমার খুব রাগ হলো। এভাবে হাসতে হাসতে আমাকে ‘না’ বলে দিল বাবা! মা কিন্তু সব খেয়াল করল। বুঝল আমি রাগ করেছি। তক্ষুণি বলল, ‘দাঁড়া, আমি মনে হয় তোর জন্য কিছু একটা খুঁজে দিতে পারব। এক মিনিট ভাবতে দে আমাকে।’
মা উবু হয়ে বসে ডিভানের নিচ থেকে একটা বড় বাক্স বের করে আনল। তার মধ্যে ছিল পুরনো খেলনা, এগুলো দিয়ে আমি তখন আর খেলতাম না, কারণ আমি বড় হয়ে গিয়েছিলাম। এর পরের শরৎকাল এলেই আমার স্কুল ড্রেস কেনার কথা। দারুণ একটা ক্যাপ কেনার কথা।
ওই বাক্সের মধ্যে মা কিছু একটা খুঁজতে লাগল। মা যখন খুঁজছিল, তখন আমি দড়িটানা চাকাবিহীন পুরনো ট্রামটা দেখতে লাগলাম। দেখলাম প্লাস্টিকের বাঁশিটা, লাট্টু, তির–ধনুক, নৌকার পাল, অনেক অনেক ভাঙা খেলনা। হঠাৎ মা ওই বাক্স থেকে খুঁজে বের করল দশাসই ভালুকটাকে!
ডিভানের ওপর মা ওটা ছুড়ে ফেলে আমাকে বলল, ‘মিলা খালা তোকে জন্মদিনে এই ভালুকটা উপহার দিয়েছিল। তোর বয়স তখন দু বছর হয়েছিল। খুব ভালো ভালুক। দ্যাখ দ্যাখ, কত টাইটফিট! পেটটা একেবারে মোটা মানুষের মতো! ঠিক জিনিসটাই বের করেছি। নাশপাতির চেয়ে ঢের ভালো। হ্যাঁ, প্র্যাক্টিস শুরু কর!’
এ সময় টেলিফোন এল, মা চলে গেল করিডোরের দিকে।
মা যে এত ভালো একটা কিছু ভাবতে পেরেছে, সেটা ভেবেই আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠল। আমি ভালুকটাকে ঠিকঠাক করে ডিভানে বসালাম, যেন ঠিকভাবে ওটার গায়ে ঘুষি মারতে পারি। ও আমার সামনে বসে ছিল একেবারে একটা আস্ত চকোলেটের মতো, আর ওর ছিল দুই রকম দুই চোখ। একটা ওর নিজের চোখ, কাচের হলুদ চোখ। অন্যটি বোতাম দিয়ে বানানো। আমার মনেও নেই, কবে এই চোখটা বসানো হয়েছে। তবে এটা বড় কোনো ব্যাপার ছিল না। দুই রকম দুই চোখ দিয়েই ভালুকটা আমাকে মহানন্দে দেখছিল। ও পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে দু হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বসে ছিল, যেন আগেভাগেই পরাজয় মেনে নিয়েছে…
আমি ওর দিকে তাকালাম আর হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ল, অনেক অনেকদিন আগে এই ভালুককে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারতাম না। যেখানে যেতাম, সেখানেই ওকে নিয়ে যেতাম, ওকে চোখে চোখে রাখতাম, খাওয়ার সময় বসাতাম পাশের চেয়ারে, চামচ দিয়ে তুলে খাওয়াতাম সুজি। ওর ঘাড়টাও হয়ে উঠেছিল চর্বিদার। আমি কখনো ওর ঘাড়ে সুজি কিংবা মিষ্টি আচার মাখাতাম, ঘাড়টা দেখতে যা হতো না! মনে হতো একেবারে সত্যিকারের ঘাড়! আমি ওকে পাশে নিয়ে ঘুমাতাম, যেন ও আমার ছোট ভাই। আমি বিড়বিড় করে কত যে রূপকথার গল্প শুনিয়েছি ওর মখমলের কানে! আমি তখন ওকে জীবন দিয়ে ভালো বাসতাম, ওর জন্য তখন জীবনও দিয়ে দিতে পারতাম। এখন ও বসে আছে ডিভানে, আমার সাবেক প্রাণের বন্ধু, শৈশবের সেরা বন্ধু! দুই রকম দুই চোখে ওর হাসি, আর আমি কিনা ওর ওপর ঘুষি প্র্যাক্টিস করার মতলব আঁটছি!…
‘কী হয়েছে তোর?’ করিডোর থেকে ফিরে মা আমাকে বলল।
আমি জানি না, তখন কী হয়েছিল আমার। আমি অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারিনি। মায়ের উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, যেন মা আমার কণ্ঠ কিংবা ঠোঁট দেখে না বুঝতে পারে, কী হয়েছে আমার। আমি দেয়ালের সঙ্গে আমার মাথা ঘসলাম, যেন আমার চোখের পানি আবার চোখের ভিতর ফিরে যায়। এরপর যখন একটু সহজ হলাম, তখন বললাম, ‘কিছু বলছিলে মা? আমার কিছুই হয়নি। এমনি একটু ভাবছিলাম। আমি আর কখনোই বক্সার হতে চাইব না।’