জাহীদ রেজা নূর
নিউ ইয়র্ক টু ল্যাংকেস্টার
পেন স্টেশন থেকে ল্যাংকেস্টারের ট্রেনে উঠতে হবে। সকাল ৯টা ৯ মিনিটে ট্রেন। সুতরাং বাস আর সাবওয়ের জন্য বেশ খানিকটা সময় বরাদ্দ রেখে আমি আর সনকা সকাল সোয়া সাতটায় কুইনস ভিলেজ থেকে বের হলাম। গন্তব্য আমিশ ভিলেজ। আরো ষ্পষ্ট করে বললে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ল্যাংকেস্টার কাউন্টির আমিশ ভিলেজ।
মে মাসের মাঝামাঝি। শীত নেই। কিন্তু আবহাওয়ার কথা আগে থেকে বলা যায় না। এই বৃষ্টি, এই রোদ। এই গরম, এই শীত। তাই ব্যাগে একটা সোয়েটারেরও জায়গা হলো।
নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়ায় ট্রেনে বা বাসে যাওয়া যায় ২ ঘণ্টায়। পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ার নামই তো শুনে এসেছি এতকাল। কিন্তু সেখানে আমরা যাচ্ছি না। বললামই তো, আমিশদের গ্রামটি ল্যাংকেস্টার শহরে। ট্রেনে যেতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। সে কথা তো জানি। কিন্তু তার আগে যে ফিলাডেলফিয়ার কথা একটু বলে নিতে ইচ্ছে করছে।
নিউইয়র্ক থেকে পেনসিলভানিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ফিলাডেলফিয়ায় পৌঁছানো যায় দু ঘণ্টার মধ্যে। এই শহরের নামে টম হ্যাঙ্কস অভিনীত খুবই জনপ্রিয় একটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল হলিউডে।
শহরটি তৈরি হয়েছিল ১৬৮২ সালে। উইলিয়াম পেনই শহরটির প্রতিষ্ঠাতা, পুরো পেনসিলভেনিয়াও তো তারই অবদান, তার নামের ‘পেন’ অংশটি যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্গরাজ্যটির নামেই লেপ্টে আছে।
ল্যাংকেস্টার রেল স্টেশনে সনকা
সে যাই হোক, ফিলাডেলফিয়ায় কিছুটা সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল কিন্তু যেহেতু সময় কম, তাই ট্রেনে সরাসরি চলে যেতে হবে ল্যাংকেস্টারে। তবে চলতি ট্রেনে বসেই ফিলাডেলফিয়া নিয়ে খুবই একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে ইচ্ছে করছে। ফিলাডেলফিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স হলটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের এক তাৎপর্যময় ভবন। ১৭৭৬ সালে এই হল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। এখানেই ১৯৮৭ সালে তৈরি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান।
ফিলাডেলফিয়া শহরের কয়েকজন শিল্পীর নাম এখানে বলে রাখা অন্যায় হবে না। ব্রাডলি কুপার, ইউল স্মিথ, গ্রেইস কেলি, রিচার্ড গির, আম্বার রোজ, কোবে ব্রায়ান্টেরা এই শহরেই সন্তান। সুতরাং হলিউড আর সংগীত জগৎকে এই শহর বিমুখ করেনি।
নিউইয়র্কে ট্রেনের ঘাটি পেন স্টেশনে এসে পোঁছুলাম যাত্রার অন্তত ৩০ মিনিট আগে। ছিমছাম পরিষ্কার স্টেশন। ডিজিটাল দুনিয়ায় একটা মোবাইল ফোনেই যাতায়াতের সকল খোঁজখবর থাকে, তাই সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল পেন স্টেশন।
এবার আগের কথা বলি। আমাদের এই ভ্রমণটি তিন দেশে বসবাসরত ছয়জন মানুষের সৌহার্দ্যের প্রকাশ। কানাডার টরন্টো শহরে থাকে বন্ধু পলা আর রিপন। ওদের ছেলে নীর আর বোন নিন্তুকে নিয়ে ওদের বসবাস। সনকা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। আর আমি বাংলাদেশে।
আমি যখন ঢাকায়, তখনই নিউইয়র্কে সন্তানদের কাছে যাব, এ কথা ওদের জানা হয়ে গেছে। ওরা ভেবে রেখেছিল, এবার আমার নিউইয়র্ক সফরের সময় একটা চমক থাকবে আমার জন্য।
কীভাবে ওদের মাথায় ভাবনাটা এল, সেটাও বলে রাখি। ওরা নেট সার্চ করতে করতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বুফের সন্ধান পেয়ে যায় ল্যাংকেস্টারে। ‘শেডি মেপল স্মোরগ্যাসবোর্ড’ তার নাম। নেটে সেটা দেখতে দেখতেই ওরা জেনে যায়, ওর আশপাশেই রয়েছে আমিশ ভিলেজ। তখনই ওরা সিদ্ধান্ত নেয় রথ দেখা আর কলা বেচার কাজটি একই সঙ্গে সম্পন্ন করবে। ল্যাংকেস্টারই হবে ভ্রমণের আদর্শ স্থান!
এরপর ওরা আমাকে ফোন করে জেনে নিল কবে আসছি আমি। তারপর পরিকল্পনার কথা বলল।
মুশকিল হলো, যে সময়ের মধ্যে এই ভ্রমণটি সম্পন্ন করতে হবে, সে সময়ে আমরা যদি ল্যাংকেস্টারেই থাকি, তাহলে ওদের পক্ষে টরন্টো ফেরা কঠিন হয়ে যাবে। তাই ওরা সরাসরি টরন্টো থেকে পেনসিলভানিয়ার এমন একটি শহরে উঠবে, যেটি সীমান্ত থেকে কয়েক ঘণ্টার পথ (সে শহরের নামটা বলব তখন, যখন সেটা জানব। আপাতত অজানাই থাকুক নামটা)। ওরা রাতে সে শহরে থাকবে। আমরা ল্যাংকেস্টারে নামব পরদিন দুপুর দেড়টার দিকে। ওরা সেই শহর থেকে ল্যাংকেস্টারে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আমিশ ভিলেজ দেখে, বুফে শেডি মেপলে রাতের খাবার খেয়ে (দুপুরে ছোটখাটো কিছু খাওয়া হবে) আমরা চলে যাব ওদের শহরে। সেখানে রাতে থেকে সকালের নাশতা করে আমরা যাব আরেকটি শহরে, যেখান থেকে আমি আর সনকা বাসে উঠব। এরপর ওরা চলে যাবে টরন্টোর পথে।
শুনতে যতোটা গোলমেলে লাগছে, বাস্তবে ততোটা জটিল নয় বিষয়টা। তবে ফেরার পথে আমাদের বাসযাত্রাটা হবে প্রায় সাত থেকে আট ঘণ্টা। সে কথা পরে বলব।
ট্রেনের সময়জ্ঞান
ভেবেছিলাম, পেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনগুলোও আমাদের কমলাপুরে থাকা ট্রেনের মতো আলস্যে পাশ ফিরে শুয়ে থাকবে। রোদ পোহাবে। তারপর জড়তাভাঙা কণ্ঠে হয়তো বলে বসবে, অপেক্ষা করো বাছা, আমি লেট।
কিন্তু সে সুযোগ দিলো না আমাদের ট্রেন। কিস্টোন অঞ্চলের ট্রেনটির নম্বর ৬৬৩। ৯টা ৯ মিনিটে হ্যারিসবার্গের উদ্দেশে সেটা যাত্রা করবে। আমরা পথিমধ্যে ল্যাংকেস্টারে নেমে পড়ব। এই হ্যারিসবার্গই পেনসিলভানিয়ার রাজধানী। আমি অন্তত এই প্রথম এই শহরটির নাম শুনলাম। আগে শুধু জানতাম ফিলাডেলফিয়ার নাম।
স্টেশন থেকে নির্দিষ্ট পথে আমাদের নিয়ে আসা হলো ট্রেনটির কাছে। বিভিন্ন বগিতে সারিবদ্ধভাবে যাত্রীরা উঠছে। আমরা একেবারে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা বগিতে পাশাপাশি দুটো সিট পেয়ে গেলাম। যে যার মতো বসে পড়ল। আর ৯টা ৯ মিনিটে হঠাৎ ছোট্ট একটা ঝাঁকুনী দিয়ে ছেড়ে দিলো ট্রেন। হ্যাঁ, ভুল শোনেননি, এক সেকেন্ডও (সেকেন্ডের হিসেব না করে এক মিনিটও বললে বুঝি ভালো) এদিক-ওদিক হলো না, ট্রেন যাত্রা করল।
পলা বলেছিল, আমার হাতের রান্না গরুর মাংস খাওয়ার ইচ্ছে ওর। আমার সঙ্গে তাই আড়াই কেজি রান্না করা গরুর মাংস। করোলির মাংস কিনেছি। আগেও রান্না করে দেখেছি, করোলির মাংসের আলাদা একটা স্বাদ আছে। যদিও ঢাকার বাড়িতে আমি স্টেক, চাপ, পুট আর সিনার মাংস কিনি, কিন্তু নিউইয়র্কে করোলির মাংসটা রান্না করলে অপেক্ষাকৃত সুস্বাদু হয় বলে আমার ধারনা। যা হোক, সেই কন্টেইনারটিও রয়েছে আমার হাতে। পিঠে ছোট একটা ব্যাগ। এক রাত থাকার জন্য যতোটা জামাকাপড় আর প্রসাধনীর প্রয়োজন, তার বাইরে কিছুই নেই তাতে।
ক’টা স্টেশন পার হলে আমরা ল্যাংকেস্টার পৌঁছুব, তা জানা আছে। স্টেশনগুলোয় যখন কিছু সময়ের জন্য থামছে ট্রেন, তখন যারা বের হবে, তারা দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে, যারা উঠবে, তারাও সময় নষ্ট করছে না। তাই সময়মতোই আবার রওনা হতে পারছে ট্রেন।
ট্রেনের কথা একটু বলতেই হয়। বাইরের কোনো আওয়াজ পাচ্ছিলাম না। কোনো ঝাঁকুনি নেই। চাইলে ট্রেনে বসে অনায়াসে বই পড়া যাবে, একটুও চোখ জ্বালা করবে না কিংবা মাথা ধরবে না।
ট্রেনে দুটো দুটো চারটে করে আসন। আমাদের এদিকে দুটো, মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথ, এরপর আবার দুটো আসন। অন্যদিকের জানালার ধারে একজন সুশ্রী মেয়ে বসে ছিল। ওর পাশে যে ছেলেটা এসে বসল, সে পরের দুটো স্টেশনজুড়ে বকবক করেই যেতে থাকল। মেয়েটা ঠাণ্ডা মাথায় মাঝে মধ্যে ‘হু হা’ করে যাচ্ছিল। আবার তারই মধ্যে মোবাইলে রাখছিল চোখ। যেন বোঝাতে চাইছিল, থামলে ভালো হয়, আমি ব্যস্ত আছি। কিন্তু কে বোঝে কার ইঙ্গিত। দুই স্টেশন পার হলে সেই ছেলেটা বেরিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কথা বো থামাল না ছেলেটা। এবার যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মেয়েটা। কিন্তু এরপর বহু সিট খালি থাকলেও ওই মেয়েটার পাশে এসে বসল আরেক তরুণ। তরুণীরা মনে হয় তরুণদের জাদুর মতো টেনে আনে নিজের দিকে। নাকি এ আমার অলস মস্তিষ্কের ভাবনা? পরের পথটুকুও নতুন আরেকজন ছেলের বকবক শুনতে হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড! ট্রেন চলা শুরু করতেই ছেলেটা ঘুমিয়ে গেল নিমিষে। আমরা ল্যাংকেস্টারে নামার আগ পর্যন্ত ছেলেটার ঘুম আর ভাঙেনি। মেয়েটাও বুঝি তাতে ফেলেছিল স্বস্তির নিশ্বাস।
প্রায় যখন পৌঁছে গেছি ল্যংকেস্টারে, তখন অবধারিতভাবেই ফোন করতে হলো পলাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য।
ফোন করল সনকা। নিন্তুকে। তখন ১২টা ১৫ অথবা ১২টা ২০ বাজে। দুপুর।
‘হ্যালো, নিন্তু মামা (সনকারা ওকে কেন যে নিন্তু মামা বলে তা আমার জানা নেই, কিন্তু সেই ডাকে মায়া আছে, সেটা বুঝি), তোমরা কতদূর?’
‘তোরা পৌঁছে গেছিস?’
‘না। আর একটু পরই পৌঁছে যাব।’
‘তোরা স্টেশনেই থাকিস। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ব।’
এরপর আরও কিছু কথা হলো ওদের মধ্যে। ওরা যেখানে রাতে থেকেছে, সেখান থেকে রওনা হয়েছে। আমরা ল্যাংকেস্টারে পৌঁছুনোর কিছুক্ষণ পরেই ওরা পৌঁছে যাবে, এ রকম একটা হিসাব করে বেরিয়েছে। এরপরই আমরা রওনা হবো আমিশ ভিলেজের উদ্দেশে।
আমরা পৌঁছুলাম ১২টা ৭ মিনিটে। ল্যাংকেস্টারের ট্রেন স্টেশনটি ছোট। আমাদের মফস্বল শহরে যেমন হয়, তেমনই। প্ল্যাটফর্ম থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে হয় স্টেশনে। স্টেশনের দোতলায় বেশ কয়েকটি দোকান রয়েছে। যাত্রীদের বসার জায়গাও আছে। আছে রেস্টরুম। রেস্টরুম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
যাত্রী সংখ্যা খুব বেশি নয়। তিন বুড়ি বসে গল্প করছেন কফি হাতে। এ ছাড়া আর কাউকে দেখা গেল না। দোকানীরাও কোথাও লুকিয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে না তাদের। শুধু কফি তৈরি করছে যে মেয়েটা, তাকে ব্যষ্ত থাকতে হচ্ছে কফির পাত্রের কাছে, ক্রেতা না থাকলেও।
আমরা শহরের দিকের দরজা দিয়ে নিচে নেমে এলাম। যাত্রী যারা নেমেছিল, তাদের কেউ উবার ডাকল, কাউকে নিতে এল তাদের আত্মীয়রা।
একটু বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ মেঘে ঢাকা।
একটি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের দুই বর্ষীয়ান এসেছেন। গাড়িতে করে তাঁদের নিতে এল সম্ভবত তাদের মেয়ে। অথবা হতে পারে ছেলের বউ। মেয়েটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুই বর্ষীয়ানের কাছে এসে তাদের জড়িয়ে ধরল পরম মমতায়। আমরা বলে থাকি, ইউরোপ-আমেরিকায় শ্রদ্ধা-ভালোবাসা উবে গেছে। এই দৃশ্য দেখলে এ ধরনের বানানো কথা হয়তো বলতাম না আর। প্রতিটি সমাজে সামাজিক নিয়মেই গড়ে উঠেছে সংসারগুলো। কে কোথায় খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, সেটা তার গ্রহণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, এমন একটা সিদ্ধান্ত বোধহয় নেওয়াই যায়। এই যে পরিবারটিকে দেখলাম, তাদের ভালোবাসার ভাষা কি আমাদের ভালোবাসার ভাষা থেকে ভিন্ন?
আমি সনকাকে বলি, আবার ফোন করতে। ওরা কতদূর আছে জানতে ইচ্ছে করে।
সনকা আমার এই আকুতিকে একেবারেই পাত্তা দেয় না। যেহেতু কথা হয়েছে, ওরা পৌঁছুলেই তো ওদের দেখতে পাব। সুতরাং, আবার ওদের তাড়া দেওয়ার কোনো মানে নেই। বহু দূরের এক শহর থেকে ওরা আসছে, সুতরাং ফোন করে ওদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলার কোনো কারণ নেই।
কথাটা সত্য। এখন ফোন করলে ওদের মধ্যে একটা অস্বস্তি আসতে পারে। আমরা পৌঁছে অপেক্ষা করছি, এটা ভেবে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলে তা হবে বিপদের কারণ।
তাই সে সময় আমরা মৃদু বৃষ্টির আলোয় উজ্জ্বল হতে থাকলাম।
শুরু হলো ল্যাংকেস্টার ভ্রমণ
অবশেষে দেখা গেল সাদা গাড়িটা। আমরা জানি, এই গাড়িটা চালাচ্ছে রিপন। সঙ্গে আছে পলা, নিন্তু আর নীর। গাড়িটারও একটা ইতিহাস আছে, সেটা এখানে বলে রাখি।
এই গাড়িটা ভাড়া করা। যে শহরে এসে এয়ারবিএনবি ভাড়া করেছে ওরা, সেই শহরের বিমানবন্দরের কাছে এক রেন্ট-এ-কার থেকে এই গাড়িটি নেওয়া হয়েছে। কারণ, টরন্টো থেকে ওরা যে গাড়িতে এসেছে, তাতে মোট ৫ জন ভালোভাবে বসতে পারে। কিন্তু আমরা সব মিলে ছয়জন। চলাচল করতে হবে বিস্তর। তাই রেন্ট-এ-কারের হাওলায় নিজেদের গাড়ি রেখে এই বড় গাড়িটা ভাড়া করা হয়েছে।
হ্যাঁ, এবার ওই শহরটার নাম বলা যায়। লক হেভেন নামের শহরটায় ওরা উঠেছে। সন্ধ্যার পর আমরা সে শহরে পৌঁছুব। আপাতত দিনের বেলায় আমাদের ঠিকানা এই ল্যাংকেস্টারই।
গাড়ি থামার পরই হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার! পলা মানেই আনন্দের প্রতীক। পৃথিবীর সব কষ্টের ধকল সহ্য করেও পলা প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে চারদিকের পরিবেশ। ওর সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, দুঃখকে একফোটা জমিও ছেড়ে দেওয়া যাবে না। দুঃখ আসবে, তবে তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এরপর আনন্দকে বেছে নিতে হবে জীবনের অনুসঙ্গ হিসেবে।
সনকা আর আমি সাদরে বরিত হলাম। নীরকে আলিঙ্গন করলাম। সনকা আর নীর দ্বিতীয় প্রজন্মের। বাকি ৪ জন প্রথম প্রজন্মের।
এই কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। আমরাও একসময় ছোট ছিলাম। এখন উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, একে একে নিবিছে দেউটি। মাথার উপরে ছায়া দেওয়ার মতো মানুষ নেই বললেই চলে।
চালকের পাশে এক আসন। পিছনে প্রথমে দুটো আসনে অনায়াসে পা ছড়িয়ে দুজন বসতে পারে। এরপর তৃতীয় সারিতে তিনটা আসন, যেখানেও পা ছড়িয়ে বসা যায়। অর্থাৎ, এই গাড়িতে ৭ জন মানুষ কোনো ধরনের জড়সড় হয়ে বসার বিড়ম্বনার দেখা পাবে না। যথেষ্ট পরিসর নিয়ে বানানো হয়েছে গাড়িটি।
গাড়িতে মোবাইলে আমিশ ভিলেজ নির্দিষ্ট করে রওনা হওয়া গেল। ম্যাপ জানাচ্ছে, ১৩ মাইল পথ পাড়ি দিলেই আমরা পৌঁছে যাব নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
ছোট্ট ছিমছাম ল্যাংকেস্টারের রাস্তা দিয়ে শুরু হলো যাত্রা। রিপন আর নীর সামনে, আমি আর পলা মাঝে। সনকা আর নিন্তু স্বেচ্ছায় বেছে নিল সর্বশেষ আসন। আমাদের জন্য ওদের এই ‘আত্মত্যাগ’।
আমরা যে পথ ধরে এগোচ্ছিলাম, সে পথে সত্যি বলতে কি কোনো শহর চোখে পড়েনি। হাইওয়ের দুপাশে কিছু দোকান দেখা গেল ঠিকই, আর দেখা গেল ফসলের ক্ষেত, কিন্তু শহরের আমেজ তাতে নেই। হয়তো বসতি একেবারে ভিন্ন কোনো দিকে। আমরা শহরের উল্টো দিকে চলেছি।
মনে পড়ল সুইডেনের স্টকহোমের কথা। দুবার গেছি সেখানে। আরল্যান্ডা বিমানবন্দর থেকে যখন বাসে করে স্টকহোমের দিকে যাচ্ছি, তখন অন্তত প্রথম ২৫ মিনিটে পথে কোনো মানুষই দেখিনি। এমনই জনবিরল ছিল সে পথ। তার তুলনায় ল্যাংকেস্টারের রাস্তা অনেক ভালো। বহু গাড়িই তো যাচ্ছে-আসছে। মনুষ্যহীন প্রান্তর নয় এটা।
রিপনকে জিজ্ঞেস করা হলো, কতোটা পথ পেরুলে তবে আমিশ দেখা যাবে?
রিপন হিসেব করে বলল, পনের মিনিটের পথ।
কিন্তু এরই মধ্যে ম্যাপের মেয়েটা (ওই যে, যে মেয়েটা আমাদের পথনির্দেশ দেয়, তার কথা বলা হচ্ছে) কিছু একটা গোলমাল করে ফেলায় ঠিক জায়গায় বাঁক নিতে না পারায় আমাদের চলার পথটা একটু দীর্ঘ হলো।
আমিশ ভিলেজ
খুব বেশি দীর্ঘ ছিল না সে পথ। একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেই হাতের বাঁয়ে দেখলাম এক বাড়িতে বড় করে লেখা ‘আমিশ ভিলেজ’। রিপন আরো কিছুদূর গিয়ে ইউটার্ন নেওয়ার মতো জায়গা বের করে আবার ফিরে এল এখানে।
আমরা তো জানি না, আসলে আমিশ ভিলেজটা কোথায়। এখানে আসার পর বোঝা গেল, এটা আসলে একটা জাদুঘরের মতো। এখানে এলে আমিশ মানুষদের জীবনযাত্রা প্রণালীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। কিন্তু মূল আমিশ ভিলেজ খুঁজতে হলে প্রয়োজন আছে একটা বাসজার্নির। প্রতিজন ২৮ ডলার খরচ করে আমিশ ভিলেজ ভ্রমণের এই সুযোগটা পাওয়া যায় এখানেই।
যার ভ্রমণ-বাসে আমরা উঠলাম, তাঁর নাম ফ্রেড। মি. ফ্রেড। আমি ভিডিও করছি দেখে তিনি আমোদের সঙ্গে বললেন, ‘আমি তো এবার বিখ্যাত হয়ে যাব! আমার ছবি ঘুরে বেড়াবে ইন্টারনেট জগতে!’
আমরা ছয়জন ছাড়াও আরো যে তিনজন এই ভ্রমণে সঙ্গী হলেন, তারাও প্রবাসী বাঙালি। মোট নয়জনকে নিয়ে শুরু হলো ফ্রেডের আমিশ গ্রাম ভ্রমণ।
শুরুতেই ফ্রেড জানিয়ে দিলেন, আমিশ মানুষদের সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের সম্পর্কের কথা। ওদের সমাজের হেন কোনো প্রশ্ন নেই, যার উত্তর ফ্রেডের অজানা। তিনি শুরুতেই অনুরোধ করলেন, আমিশরা প্রযুক্তির কাছ থেকে দূরে থাকে। তাই ওদের কারো সঙ্গে পরিচয় হলে কেউ যেন ছবি না তোলে। দূর থেকে ছবি তুললে ক্ষতি নেই। কিন্তু সামনাসামনি ছবি তোলা বারন।
আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, আমিশদের আলাদা কোনো গ্রাম আছে বুঝি। কিন্তু এখানে আসার পর বোঝা গেল, সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের মধ্যেই আমিশরা মিশে আছে। দশ-বারোটি সাধারণ বাড়ির পর হয়তো একটা আমিশ বাড়ির দেখা মিলবে। দশ-বারোটি খামারের পর হয়তো একটা আমিশ খামারের দেখা মিলবে।
আমিশদের চিনে নেওয়ার উপায় হলো, তাদের একেবারে সাদামাটা পোশাক। পরনে প্রায় সবার থাকে একই রকম অনাড়ম্বর পোশাক। যে কেউ তাদের দেখলে চিনতে পারবে—এরাই আমিশ। আমিশদের বাড়িগুলো আধুনিক প্রযুক্তির থেকে অনেক দূরে থাকে। ও সব বাড়িতে বিদ্যুৎচালিত এসি, বাতি কিচ্ছু নেই। টেলিভিশন নেই। সোলার প্যানেল আর ব্যাটারি দিয়ে নিজেদের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ওরা ইঞ্জিনের গাড়িতে চড়ে না। এখনও চলাচলের বাহন বলতে ঘোড়ার গাড়ি। খামারে গরু ঘোড়া চড়ে বেড়াতে দেখেছি। একটা আমিশ দোকানের পাশে পোক্ত মোরগ আর ছাগলেরও দেখা মিলেছিল।
মি. ফ্রেড গাড়ি চালাতে চালাতে মাইক্রোফোনে বর্ণনা করে চলেছিলেন। লাউড স্পিকারে ভেসে আসা তথ্যগুলো আমাদের সমৃদ্ধ করছিল।
আমরা একটা আমিশ স্কুল দেখলাম। সাধারণ স্কুলের সঙ্গে এই স্কুলের পার্থক্য হলো, একটা ঘরেই ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাস চলে। আমিশরা ক্লাস এইট পর্যন্তই পড়াশোনা করে। এটাকে ওয়ান রুম স্কুল বলা হয়। বাস থেকেই সে রকম একটি স্কুল দেখলাম।
ক্লাস এইটের পর আমিশদের আর পড়াশোনা নয়।
আগে তো আমিশদের প্রায় সবাই খামারে কাজ করতো, এখন খামারে অনেকে কাজ করলেও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে বাড়ির অঙ্গসজ্জায় (ইন্টেরিয়ার) তাদের হাতযশ আছে। আমিশরা খুব ভালো আসবাবপত্র বানায়। এগুলো এতোটাই টেকসই যে বংশপরম্পরায় তা ব্যবহার করা চলে। এখন অবশ্য আমিশদের মধ্যে ব্যবসাও করছেন অনেকে। ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন, এমন আমিশও আছেন।
আমিশদের বাড়িতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা বারন। এমন কি ল্যান্ড ফোনও নেই বাড়িতে। কোনো ধরনের যান্ত্রিক ওয়েভ বাড়িতে অশুভের জন্ম দেয়। তাই বাড়িতে ফোনের দরকার নেই। গ্রামের কোথাও কোথাও টেলিফোন বুথ আছে। যদি খুব প্রয়োজন হয় কারো সঙ্গে কথা বলার, তাহলে অনুমতি নিয়ে সেই টেলিফোন বুথ ব্যবহার করে কথা বলে তারা।
ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে আমিশরা। আমিশ শিক্ষকও এইট পাশ। তাই তাদের মধ্যে চিকিৎসক থাকার কোনো সুযোগ নেই। কেউ এখন বড় ধরনের অসুখে পড়লে ইংরেজ ডাক্তার ডাকা হয়। রোগীকে জরুরি প্রয়োজনে বিমানে করে অন্য কোথাও নিতে হলে আমিশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।
বাস থেকেই বেশ বিচিত্র কিছু দৃশ্য দেখলাম। প্রথমে কয়েকটি বাড়ি, যার সামনে দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট কার। বৈদ্যুতিক তার। কিন্তু এরপর একটা বাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি। কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক খুটি বা তার সেখানে নেই। জানালায় সবুজ পর্দা।
রাস্তায় দূর থেকেই দেখা যায় কোনো ঘোড়ার গাড়ি আসছে। বাসের মধ্যে থাকায় ফোনের ক্যামেরায় সে দৃশ্য ভিডিও করি। দ্রুত বাসের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় সে গাড়ি। ক্ষণিকের জন্য আমরা দেখতে পাই আমিশ মানুষদের। হ্যাঁ, এই মানুষেরা মার্কিন নাগরিক বটে, কিন্তু ফুড স্ট্যাম্প বা বীমাজাতীয় কোনো কিছুর সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। স্থানীয় পর্যায়ে হয়তো ভোট দিতে যায়, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কোনো উৎসাহ এদের মধ্যে দেখা যায় না।
মি. ফ্রেড বলছিলেন, ‘পারিবারিক বন্ধনটাই আসল। এরা অকারণে বাইরে সময় কাটাতে পছন্দ করে না। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়ার মধ্যে তাদের সুখ। খাদ্যও খুব সাদামাটা। কিন্তু খুবই সুস্বাদু। বিশেষ করে বেক করা খাদ্যের খুব কদর এখানে।
ভুট্টা, সয়াবিন আর তামাক উৎপাদন করে আমিশরা। রোববার মানে ছুটি। সেদিন আমিশদের দোকানপাট খোলা হয় না, ক্ষেতের কাজেও কেউ যায় না। ছুটি মানে ছুটি।
আর একটা তথ্যও বিষ্ময়কর। আমিশদের অনেকেই সারা জীবনে ল্যাংকেস্টারের বাইরে কোথাও যায়নি। নিজের এলাকাতেই থাকে তারা। সেখানেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়।
অতীত ভ্রমণ
চারদিক দেখে আমরা মুগ্ধ। তবে সে সব দেখতে দেখতে এক সময় আমাদের মনে হয়, এই আমিশেরা যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে এল? নাকি এরা এখানকার আদিবাসী মানুষ? এই যে আমরা শুনলাম সাধারণ জীবনধারন পদ্ধতি গ্রহণ করা, সরল পোশাক পরিধান করা আর প্রযুক্তির কাছ থেকে দূরে থাকার যে জীবন, সেটা তারা কোথায় পেল? আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার এই আমিশ ভিলেজেই সবচেয়ে বেশি আমিশদের বসবাস। তার মানে এই এলাকা ছাড়া আরও কিছু অঞ্চলে আমিশরা থাকে। এরা কি এখানকার আদিবাসী?
এ প্রশ্নের উত্তর যদিও অন্তর্জাল ঘাটলেই পাওয়া যায়, তবুও এই ভ্রমণকাহিনী যারা পড়ছেন, তাদের কেন আবার অন্তর্জালের সাহায্য নিতে বলব? এখানেই তার কিছুটা পরিচয় দেওয়া যাক।
আমিশরা আসলে এসেছে সুইজারল্যান্ড থেকে। ইতিহাস জানাচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে ইয়াকব (জ্যাকব) আম্মান বলে একজন ভিন্ন মতাবলম্বী খ্রিস্টান ধর্মযাজক ছিলেন। তিনি সেখানকার মন্ত্রীও ছিলেন। সেই সুদূর ১৬৯৩ সালে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সঙ্গে তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি ‘প্রকৃত বাইবেলীয়’ জীবনধারা নিয়ে নিজের একটি মতবাদ তৈরি করেছিলেন। এই মতে যারা সায় দিয়েছিল, তারা পরিচিত হলো আমিশ বলে।
এই আমিশেরাই পরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায়ও এল তাদের একটি অংশ। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় এরা স্বচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে শুরু করল। তবে ওহাইও, নিউইয়র্ক, ইন্ডিয়ানা, মিশিগানসহ আরো কিছু অঙ্গরাজ্যে রয়েছে আমিশেরা।
ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, ১৭৩৬ সালে ডেটওয়েইলার ও সাইবার পরিবারের লোকেরা উত্তর আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার বার্কস কাউন্টির নর্থকিল ক্রিক ও আইরিশ ক্রিক এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। পরের বছরই অর্থাৎ ১৭৩৭ সালে চার্মিং ন্যান্সি ২১টি পরিবার নিয়ে উত্তর আমেরিকা যাত্রা করেন। এ সময় থেকেই আমিশ অভিবাসন শুরু হয়। ফরাসী এবং রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তার প্রশ্নে বার্কস কাউন্টি থেকে ল্যাংকেস্টার কাউন্টিতে চলে আসে অধিকাংশ আমিশ।
আমিশেরা কী খায়?
আমরা একটি আমিশ দোকানে থেমেছিলাম। সেখানে কেনাকাটা, খাওয়ার কথা একটু পরে বলব। তার আগে বলতে চাই, আমিশদের খাবারের মধ্যে চিকেন রয়েছে। রোস্টেড চিকেন। সুস্বাদু ম্যাশড পটাটোর কথা না বললে নয়। সবজি, সদ্য ওভেন থেকে নেমে আসা রুটি আর ঘরে তৈরি জ্যাম—এতেই পেটের খিদে নিবারণ করতে পারে আমিশেরা।
আমিশদের তৈরি বিস্কুট (কুকিজ), রুটি, কেক এবং পাই খুবই নামকরা খাবার।
চলতে চলতে একসময় মি. ফ্রেড বললেন, ‘এবার আমরা একটা আমিশ দোকানে থামব। সেখানে আমিশদের তৈরি খাবার কিনতে পাওয়া যায়। কেউ ইচ্ছে করলে তা কিনতে পারে।’ তিনি জোর দিলেন প্রিটজেলে।
রুটির মতো এই খাদ্যটি যে এক সুস্বাদু হতে পারে, তা খাওয়ার আগে বুঝতে পারিনি। সেই দোকানটিতে নামার পর তিন বয়সী তিন আমিশ নারীর দেখা পাওয়া গেল। একজন বর্ষীয়ান, ষাট ছাড়িয়েছে। একজন তরুণী, অন্যজন বালিকা। বালিকা একটা প্লেটে করে প্রিটজেলের কিছু অংশ বিনে পয়সায় খেতে দিল। রিপন প্রত্যেকের জন্য একটি করে প্রিটজেল কিনল, নিন্তু কিনল কিছু আচার আর জ্যাম। বাসে উঠে গরম সেই প্রিটজেল খেয়ে মনে হলো, সত্যিই, আমিশদের এই খাবারের স্বাদ ভুলবার নয়।
বাসে কথা বলার সুযোগ ছিল না। মি. ফ্রেড একাই বক্তা। তাঁর একটি কথা খুব মনে ধরল। আমিশদের চোখে তারা নিজেরা ছাড়া আর সবাই ইংলিশম্যান। অর্থাৎ আমাদের মতো বাদামী, কালো রঙের চামড়ার মানুষেরাও সাদাদের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আমরা সবাই ইংলিশম্যান। আর তাই আমিশদের সঙ্গে দূরত্বটা কেবল মার্কিন নাগরিক অথবা সাদাদেরই নয়, আমাদেরও। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আমিশ না হচ্ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পরিচয় ইংলিশম্যান। আমিশে পরিণত হওয়ার সুযোগ আছে। ব্যাপ্টিস্ট চার্চে নিজেকে পরিবর্তন করে নিলে সেটা সম্ভব। কিন্তু খুব কম সংখ্যক মানুষই আমিশ হয়েছে এই তিন-চারশো বছরে। আধুনিক জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমিশ হওয়া খুব সহজ কথা নয়।
কথা শুনতে শুনতে পলা বলল, ‘এটা ওদের বাড়াবাড়ি। একটা মোবাইল ফোন হাতে থাকলে কী এমন ক্ষতি?’
নীর মায়ের কথার প্রতিবাদ করে বলে, ‘ওরা যদি আধুনিক জীবনকে দূরে রাখতে চায়, তাহলে রাখুক না।’
আমার মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের চরণ, ‘দাও ফিরিয়ে এ অরণ্য, লহ হে নগর।’ বুড়ো নিশ্চয় আমিশদের কথা ভেবে তা লেখেননি। কিন্তু সেটা আমিশদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে যেন।
আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দোকানে থাকা তিন আমিশ নারীর ছবি তোলার। কিন্তু মি. ফ্রেড আগেই নিষেধ করে দিয়েছিলেন। তাই ছবি তোলা হলো না। দোকানের পাশেই কাঠের দেয়াল দেয়া ছোট্ট যে জমি আছে, আমি তখন সেখানে চলে গেলাম। সেখানে হৃষ্টপুষ্ট ছাগল আর রাগি কিছু মোরগ-মুরগি দেখার সৌভাগ্য হলো। এরা কৃত্রিম খাবার খায় না। প্রাকৃতিক খাবারের ওপর নির্ভর করেই এরা বেড়ে ওঠে। ফেরার পথে কৌশলে দোকানটার ছবি তুললাম। কিন্তু তখন দোকানে আমিশ তিন নারীর কেউ নেই। তারা এরই মধ্যে লুকিয়েছেন পিছনে। সম্ভবত তারা জানেন, বিদায়কালে কেউ কেউ তাদের ছবি তোলার চেষ্টা করতে পারে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি। ছোট্ট বালিকাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল লরা ইঙ্গেলসের লেখা ‘লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি’র ছোট্ট লরা ইঙ্গেলসের কথা। এই মেয়েটির পোশাকও ছিল লরার মতো।
প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল বাসে করে পুরো আমিশ গ্রামটি ঘুরে আসতে। এর মধ্যে আরেকটি দারুণ জায়গা আমরা দেখেছি। এখানেই ট্রেনের বাতিল ওয়াগন দিয়ে বানানো হয়েছে মোটেল। বাইরে থেকে পুরনো ওয়াগন, কিন্তু ভিতরে খুবই পরিপাটি। এটা আমিশদের নয় বলে বিশদ আলোচনায় গেলাম না। কিন্তু এটা তো এখানে বলাই যায় যে, ট্রেনের ওয়াগন দিয়ে রাতারাতি এই নিভৃতে পাঁচতারা হোটেল তৈরি করাও অভিনব বটে!
আমরা যখন ফিরে এসেছি আগের জায়গায়, তখন ভাবছিলাম, খিদে লাগছে না কেন? মনে পড়ল, আমিশদের দোকানে কেনা প্রিটজেল খেয়েই তো পেট ভরেছি, এখন কি আর খিদে লাগবে?
এরপর আমরা সাদী মেপলে (শ্যাডি বললেই ঠিক বলা হয়, ‘ছায়াচ্ছন্ন মেপল’ই তো) গিয়েছিলাম রাতের খাবার খেতে। সে গল্প অন্য কোনোখানে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বুফেতে খাওয়ার অভিজ্ঞতা আলাদা করেই তো বলতে হবে। আপাতত আমিশ ভিলেজ ভ্রমণের আমেজ নিয়েই শেষ করি লেখাটা।