নীল দাড়ি | জাহীদ রেজা নূর

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

শার্ল পেরো
অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর

এক দেশে ছিল খুব বড়লোক একজন। তার ছিল সুন্দর এক বাড়ি। বাড়ির সব থালা-বাসন ছিল সোনা-রূপার। নিখুঁত খাট-পালং, বিলাসে ভরপুর ঘোড়ার গাড়ি, আরো কত যে ছিল সম্পদ, তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তার দাড়িগুলো ছিল নীল রঙের। তার দিকে তাকিয়ে নীল দাড়ি দেখলেই যে কোনো মানুষ ভয় পেয়ে যেত। বড়লোকটাকে কেউ তার নাম ধরে ডাকত না, সবাই তাকে ডাকত নীল দাড়ি বলে।

পাশের বাড়িতে যারা থাকত, তাদের ছিল সুন্দরী দুই মেয়ে। নীল দাড়ি সে বাড়িতে লোক পাঠাল, তাদের জানিয়ে দিতে বলল, দুই মেয়ের কোন মেয়েকে তারা নীল দাড়ির সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়, তা জানাতে। মেয়ে দুজনের মন খুব খারাপ হলো। ওরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেল এই ভেবে যে, নীল দাড়ি এর আগেও কয়েকটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু বিয়ের পর সে মেয়েদের আর কেউ কোনোদিন দেখতে পায়নি। ওরা উধাও হয়ে গিয়েছিল।
নীল দাড়িকে যেন সহজে চিনে নেওয়া যায়, সে জন্য মা-সহ মেয়ে দুজনকে আর তার কাছের বন্ধুদের নিয়ে শহরের বাইরের প্রাসাদে চলে এল নীল দাড়ি। পুরো এক সপ্তাহ তারা সে বাড়িতে দিন কাটাল। অতিথিরা হই হই করে ঘুরে বেড়াতে লাগল, শিকারে গেল, গেল মাছ ধরতে, নাচল, মানে যতরকমভাবে আনন্দ করা যায়, করতে লাগল; সবাই খুব মজা করল। আর সে সময় দুবোনের ছোট যে, তার মনে হলো, আরে! নীল দাড়িকে ভয়ের কী আছে! তার দিকে তাকিয়ে নীল দাড়ির মনে হলো, এ রকম ভদ্রলোক আর ক’জন হয়? তাই অতিথিদের নিয়ে শহরে ফেরার পর আর দেরি করা গয়নি, সেদিনই পাশের বাড়ির ছোট মেয়ে আর নীল দাড়ির বিয়ে হয়ে গেল।
পরের মাসে নীল দাড়ি এসে তার বউকে বলল, ‘আমি কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে গেছে। ছয় সপ্তাহ আমি বাইরে থাকব।’
এরপর নীল দাড়ি বউকে আবার বলল, ‘আমার কথা ভেবে মন খারাপ কোরো না। বরং খুশিমনে যা ইচ্ছে তা কোরো।’

এরপর নীল দাড়ি বাড়ির চাবিগুলো এগিয়ে দিল বউয়ের দিকে। বলল, ‘এই দুটো চাবি হলো দুই স্টোর রুমের। এই চাবিটা দিয়ে সেই আলমারিটা খুলবে, যেখানে সোনার আর রূপোর থানাবাসন আছে। এগুলো অবশ্য প্রতিদিন কাজে লাগে না। এই চাবি দিয়ে খুলতে পারবে টাকা-পয়সার সিন্দুক। এই চাবিটা দামি সোনা রূপার অলঙ্কারের সিন্দুকের। আর এই চাবিটা দিয়ে যে কোনো ঘরের তালা খুলতে পারবে। আর এই শেষ চাবিটা হচ্ছে নিচতলার একটা ঘরের। অন্য সব চাবি দিয়ে সব ঘর, সব সিন্দুক, সব আলমারি খুলতে পারবে। কিন্তু এই শেষ চাবিটা দিয়ে নিচের ঘরের তালা ভুলেও খুলবে না। আমি নিষেধ করছি। আর আমার নিষেধ অমান্য করলে ভয়ঙ্কর শাস্তি হবে। খবরদার, ওই দরজা খুলবে না। আমার নিষেধ অমান্য করলে আমি খুব রাগ করব।’
নীল দাড়ির বউ কথা দিল, অক্ষরে অক্ষরে সব নির্দেশ মেনে চলবে। বউকে চুমু খেয়ে নীল দাড়ি ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে দিল পথে।
যে-ই না নীল দাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে, অমনি পাড়াপড়শীরা আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই ছুটে এল নীল দাড়ির প্রাসাদটা দেখতে। লোকে যেভাবে নীল দাড়ির টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ির প্রশংসা করে, তা সত্য কিনা, সেটা জানতে পড়শীদের আর তর সইছিল না। নীল দাড়ি বাড়ি ছাড়ার আগে পড়শীরা এ বাড়িতে ঢুকতে সাহস করেনি। ওরা সবাই নীল গাড়িকে খুব ভয় করত। তারা বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আর বিস্ময়ভরা চোখে এ বাড়ির জৌলুস দেখতে লাগল। যা দেখল, তা-ই তাদের চোখে ভালো লাগলে লাগল। আর মনে হতে লাগল, এত বড় বড় সব কিছু। এ-ও সম্ভব! তবে এ বাড়ির বউ যে, সে কিন্তু এ সব সোনাদানা, টাকাপয়সার কথা ভাবছিল না। সে চাইছিল জানতে, নিচের ঘরটায় কী আছে?
নীল দাড়ি যে ঘরটায় ঢুকতে মানা করে গেছে, সেই ঘরটায় ঢোকার জন্য নীল দাড়ির বউয়ের মনটা আকুপাকু করতে লাগল। সে ঘরে যাওয়ার টান এতোটাই বাড়ল যে, অতিথিদের রেখেই সে রওনা হয়ে গেল নিচতলার দিকে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে এক সময় সেই নিষিদ্ধ ঘরের দরজার সামনে এসে পড়ল। এরপর বাতাসে গাছের পাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে দরজাটা চাবি দিয়ে খুলে ফেলল।

প্রথমে বউটা তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। নিষিদ্ধ ঘরটা ছিল অন্ধকার। জানালাগুলো ছিল বন্ধ। কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে সে দেখতে পেল নীল দাড়ির আগের বউয়েরা এখানে সবাই মরে পড়ে আছে। আতঙ্কে ওর হাত কাঁপতে লাগল এবং ছোট চাবিটা হাত থেকে খসে পড়ল মেঝেয়।
তখন সম্বিত ফিরে পেল বউটি। চাবিটা তুলে নিল সে, দরজা বন্ধ করল তারপর নিজের ঘরের দিকে চলল বিশ্রাম করবে বলে। কিন্তু বউটা এতোটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছিল না।
বউটা খেয়াল করল, সেই ছোট্ট চাবিটায় কী সব লেগে আছে। পরিষ্কার করার চেষ্টা করল সে। পরিষ্কার হলো না। দাগ রয়েই গেল চাবিতে। চাবিটাকে ধুলো, কাচল, এমনকী বালু আর ইট দিয়েও ঘষা-মাজা করে দেখল, কিন্তু যে-ই কে সে-ই। ময়লা আর পরিষ্কার হয় না। আসলে চাবিটা ছিল জাদুর চাবি, তাই এই ময়লা পরিষ্কার করা যায় না। একদিকের ময়লা সরে গেলে অন্যদিকে ময়লা হয়ে যায়।

সেদিন সন্ধ্যায় ফিরে এল নীল দাড়ি। বউকে বলল, যাওয়ার পথেই একটা চিঠি পেয়েছিল সে। সে চিঠিতে লেখা ছিল, যে কাজে যাচ্ছিল, সে কাজ হয়ে গেছে। তাই আর না গিয়ে ফিরে এসেছে বাড়িতে। বউ এমন ভাব করার চেষ্টা করল যে, নীল দাড়ি ফিরে এসেছে বলে সে খুব খুশি হয়েছে।
পরদিন সকালে নীল দাড়ি বলল, ‘আমার চাবিগুলো আনো।’
বউটা চাবিগুলো নীল দাড়িকে দিল। কিন্তু দেওয়ার সময় ভয়ে ওর হাত-পা এমনভাবে কাঁপছিল যে, নীল দাড়ি এমনিতেই বুঝে নিল, কী ঘটেছে তার অনুপস্থিতির সময়।
‘নিচতলার চাবিটা দাওনি কেন? অন্য চাবিগুলোর সঙ্গে সে চাবিটা দাওনি কেন?’ বউকে জিজ্ঞেস করল নীল দাড়ি।
‘আমি মনে হয় সেই চাবিটা উপরের ঘরে রেখে এসেছি।’ বলল বউ।
‘নিয়ে এসো।’ বলল নীল দাড়ি।
বউ কয়েকবার নানা কথা বলে নীল দাড়িকে ভোলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সে তাতে ভুলল না। চাবি না এনে আর উপায় ছিল না। তাই চাবিটা নীল দাড়ির হাতে দিল বউ।
‘চাবিতে এটা কিসের দাগ?’ জিজ্ঞেস করল নীল দাড়ি।
‘সে তো আমি জানি না।’ এ রকম একটা উত্তর দিল ঠিকই, কিন্তু ভয়ে কাফনের মতো সাদা হয়ে রইল মেয়েটা।
‘তুমি জানো না? তাই বলতে চাইছ! শোনো তবে, আমি জানি। তুমি ওই নিষিদ্ধ ঘরে ঢুকতে চেয়েছিলে। খুব ভালো কথা। ওই ঘরেই তোমাকে ঢুকতে হবে। ওই ঘরেই যে মেয়েদের তুমি দেখেছ, তাদের মধ্যেই তোমাকে জায়গা করে নিতে হব।’ বলল নীল দাড়ি।
বউ নীল দাড়ির পায়ে পড়ল। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ওর কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। এ রকম সুন্দরী একটা মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখলে শক্ত পাথরও নরম হয়, কিন্তু তাতে নীল দাড়ির মন গলল না। তার মন পাথরের চেয়েও শক্ত ছিল ।

নীল দাড়ি বলল, ‘তোমাকে মরতে হবে। এখনই মরতে হবে।’
‘যদি সত্যিই আমাকে এখনই মরতে হয়, তাহলে আমাকে একটা মিনিট সময় দাও। ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে নিই।’
নীল দাড়ি বলল, ‘তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর চেয়ে এক মুহূর্তও বেশি না।’
এই কথা বলে নিচে চলে গেল নীল দাড়ি।
আর সেই ফাঁকে নিজের বোনকে ডেকে আনল বউটি। তাকে বলল, ‘ আন্না, বোন আমার! টাওয়ারের একেবারে উপরে উঠে যাও। দেখ, আমাদের ভাইয়েরা আসছে কিনা। ওরা আমাকে আজ দেখতে আসবে বলেছিল। ওদের আসতে দেখলে তুমি তাদের তাড়াতাড়ি আসতে ইশারা কোরো।’
আন্না টাওয়ারের ওপরে উঠল। আর ভয়ার্ত বোনটা একটু পর পর বোনতে জিজ্ঞেস করে, ‘আন্না, বোন আমার, তুমি কি কিছু দেখতে পাও?’
আন্না উত্তর দেয়, আমি দেখছি সূর্য, আর সবুজ নালী ঘাস।
আর তখন নীল দাড়ি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে চিৎকার করছে, ‘নিবচে নেমে এস, বউ!’
‘এক মিনিট!’ বলল বউ, তার ফিসফিস করে বোনের কাছে জানতে চাইল, ‘আন্না, বোন আমার, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
আন্না উত্তর দিল, ‘আমি ধুলোর মেঘ দেখতে পাচ্ছি। ওটা এদিকেই আসছে।’

বউটা খুশী হয়ে বলল, ‘আমার ভাইয়েরা আসছে?’
‘না। ওটা ভেড়ার পাল।’
‘তুমি কি আসবে?’ চিৎকার করল নীল দাড়ি।
‘ছোট্ট একটা মুহূর্ত অপেক্ষা করো।’ অনুনয় করল বউ, আর কোনের কাছে ফিসফিস করে জানতে চাইল, ‘আন্না, বোন আমার, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
আন্না বলল. ‘আমি আমাদের ভাইদের দেখতে পাচ্ছি। আমি ওদের ইশারা করছি, যেন ওরা খুব তাড়াতাড়ি এদিকে চলে আসে।’
ঠিক তক্ষুণি নীল দাড়ি এমন চিৎকার-চ্যাঁচামেচি শুরু করল যে, ঘরের দেয়ালগুলোও কাঁপতে শুরু করল। বেচারা বউ নিচে নেমে এল এবং নীল দাড়ির পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল।
নীল দাড়ি বলল, ‘এসব কান্নাকাটি তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমার মৃত্যুর সময় চলে এসেছে।’
নীল দাড়ি মেয়েটাকে ধাক্কা দিল….মেয়েটা তার নিস্তেজ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,‘আমাকে আর একটা মুহূর্ত দাও, শুথু একটা মুহূর্ত, মৃত্যুর জন্য আমি তৈরি হয়ে নিই…’
‘না, আর এক মুহূর্তও নয়।’ বলল নীল দাড়ি। তারপর মেরে ফেলার জন্য হাত উঠালো ওপরে।
কিন্তু ঠিক সে সময় দরজায় এমনভাবে কেউ ধাক্কা দিল যে নীল দাড়িকে থামতেই হলে, দেখতে হলো কী ঘটতে চলেছে…
দরজা খুলে গেল, আর ঘরে এসে ঢুকল দুই যুবক। তলোয়ার হাতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল নীল দাড়ির ওপর।

নীল দাড়ি জানত, এই দুই যুবক তার বউয়ের ভাই, তাই ভয়ে সে পালাতে শুরু করল। কিন্তু ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার আগেই দুই ভাই তাকে ধরে ফেলতে পারল…
এরপর দিন কাটতে লাগল। মেয়েটা আবার বিয়ে করল। এবার অবশ্য বড়লোক খুঁজে বিয়ে করেনি সে, একজন সৎ ভালো মানুষকে বিয়ে করল। নতুন বরটা এত ভালো ছিল যে, আগের জীবনের আতঙ্ক আর ভয় একেবারেই ভুলে গেল মেয়েটা, মনেই রাখল না, একদা এক ভয়ঙ্কর নীল দাড়ির বউ ছিল সে!

ছবি এঁকেছে: ইউলিয়া উসতিনোভা

আরও লেখা

তুষারকন্যা
শিশু ও কিশোর সাহিত্য

তুষারকন্যা

রুশদেশের উপকথাঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ি। ভালোই তো ছিল

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top