হাফিজের চোখ | জাহীদ রেজা নূর
krac

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

জাহীদ রেজা নূর

হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ করে বেহালা বাজাচ্ছেন। তন্ময় হয়ে বেহালার সুরে তিনি মোহগ্রস্ত করে তুলছেন আশপাশ। এবং তারপরই ভাবনাটার মধ্যে কেমন যেন এক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং দেখতে পাই বেহালাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে আর কোটর থেকে বের হয়ে গালের সামনে এসে ঝুলছে অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হাফিজের একটি চোখ!
না। এভাবে আর ভাবনাকে এগিয়ে নেওয়া যায় না।
যারা আজকাল ইতিহাসের পথটাকে একটা বাঁকহীন সরলরেখা বলে ভাবতে শুরু করেছেন, তারা কোনোদিন বুঝবেন না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে কতোগুলো স্তর ছিল। স্রেফ সীমানা অতিক্রম করলেই মুক্তিযোদ্ধা আর নিজের দেশে বসবাস করলেই সে রাজাকার—এই বয়ানে বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা কম নয়। একাত্তরের ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানিরা। সেদিন এই নৃশংসতা চালিয়ে তারা আসলে নিজেরাই পাকিস্তানের কবর রচনা করেছিল। বাঙালিদের মধ্যে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়েছিল, সে মুক্তির পথ খুলে গিয়েছিল এই ২৫ মার্চেই। কিন্তু এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দেশের মানুষ দলে দলে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বিস্মৃত হয়েছে যারা, তাদের মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, যে এক কোটি মানুষ ১৯৭১ সালের বিভিন্ন সময় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত ৯০ লাখ মানুষ ছিলেন উদ্বাস্তু। বাকি ১০ লাখের কাছাকাছি মানুষদের মধ্যে ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাকিরা নানা ভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন অথবা নানাভাবে নিজেদের সেখানে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এদের সবার যাপিত জীবন প্রশংসাযোগ্য ছিল, তা-ও নয়।

যারা ইতিহাস রচনা করেছেন, তাদের বেশিরভাগই ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকার কিংবা সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর গল্পই বলতে চেয়েছেন। গানের বাংলাদেশ, ফুটবলের বাংলাদেশ, হাসপাতালের বাংলাদেশের কথা কোথাও কোথাও এসেছে বটে, কিন্তু যতোটা গুরুত্বের সঙ্গে কথাগুলো আসা উচিৎ ছিল, ততোটা গুরুত্বের সঙ্গে আসেনি। আর ক্র্যাক প্লাটুন? হ্যাঁ, এই একদল অদম্য যুবকের কথাও তো বলতে হবে আমাদের। বুঝতে হবে, কোন এক অবস্থায় দেশের মানুষের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছিল এই মুক্তিকামী যুবকেরা।

বাকি সাড়ে ৬ কোটি মানুষ কিন্তু ছিল পাকিস্তানি সেনানিয়ন্ত্রিত এবং রাজাকার-আলবদরদের দ্বারা আচ্ছাদিত সেই ভূখণ্ডে, অচিরেই যার নাম হয়েছে বাংলাদেশ। তারা কীভাবে এই শত্রুকবলিত ভূখণ্ডে জীবন কাটিয়েছেন, সে গল্পটা রণাঙ্গণের গল্পের চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। পরতে পরতে দেশপ্রেমের যে আভা তারা ছড়িয়েছেন, সে কাহিনী আজও অনুদ্ঘাটিত। যারা ইতিহাস রচনা করেছেন, তাদের বেশিরভাগই ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকার কিংবা সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর গল্পই বলতে চেয়েছেন। গানের বাংলাদেশ, ফুটবলের বাংলাদেশ, হাসপাতালের বাংলাদেশের কথা কোথাও কোথাও এসেছে বটে, কিন্তু যতোটা গুরুত্বের সঙ্গে কথাগুলো আসা উচিৎ ছিল, ততোটা গুরুত্বের সঙ্গে আসেনি। আর ক্র্যাক প্লাটুন? হ্যাঁ, এই একদল অদম্য যুবকের কথাও তো বলতে হবে আমাদের। বুঝতে হবে, কোন এক অবস্থায় দেশের মানুষের মনে আশার আলো জ্বালিয়েছিল এই মুক্তিকামী যুবকেরা।
আমরা সেই সাড়ে ছয় কোটি মানুষের কথা বলছি, যারা জীবন বাজি রেখে শত্রু-পরিবেষ্টিত অবস্থায় সাহায্য করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। জাতীয় জীবনের সেই আঁধারে ফলিয়েছে আশাবাদের ফসল। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ত্যাগের কথা ঠিকভাবে আসেনি আমাদের যুদ্ধ-সাহিত্যে।
এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে আমরা হাফিজকে দেখি। হ্যাঁ, বেহালা হাতে যে হাফিজের কথা বলছি, তাকেউ তো আমরা দেখতে পাচ্ছি ঠাণ্ডা মাথায় ঢুকে যাচ্ছে শত্রুশিবিরে। নিরাবেগ অহংকারে ধ্বংস করছে শত্রুসেনার অস্তিত্ব।

২.
ওই তো, আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে যাকে দেখা যাচ্ছে, তিনিই তো হাফিজ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এপ্রিল মাসের দিকে আলতাফ মাহমুদ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের খুঁজে বের করার জন্য। শিল্পীদের কারো কারো সঙ্গে যোগাযোগ হলো তাঁর। সে সময় হাফিজ ছিলেন আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গী। সুর যেন ছিল তাঁর আমৃত্যু স্বজন। কিন্তু সেই সাঙ্গীতিক আবহের মধ্যেই তিনি পেলেন স্বাধীনতার ঘ্রাণ। আর সে ঘ্রাণের সন্ধানেই তাঁকে বেছে নিতে হলো ক্র্যাক প্লাটুনকে। আহা! কি অসাধারণ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই গানের মানুষটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলেন!

হাফিজ তো ভারতে যাননি। পঞ্চাশ আর ষাটের দশক জুড়ে পূর্ব বাংলা উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদের প্রাণদায়ী বাতাসে। সে বাতাসেই ছিল হাফিজের শ্বাস-প্রশ্বাস। তাই ১৯৭১ সালে অবরূদ্ধ ঢাকায় বসে কী করতে হবে, সেটা কেউ এসে তাঁকে শিখিয়ে দিয়ে যায়নি। কাজগুলো যেন স্বতঃসিদ্ধের মতো তাঁর কাঁধে এসে ভীড় জমিয়েছিল। সে এক অদ্ভুত সময়। তখন যে কোনো মানুষই পরিণত হচ্ছিলেন এক একজন যোদ্ধায়। সে যুদ্ধের যে রকমফের ছিল কত, সে কথা কি আজকের দিনে এসে আর অনুভব করা যাবে?


হাফিজ তো ভারতে যাননি। পঞ্চাশ আর ষাটের দশক জুড়ে পূর্ব বাংলা উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদের প্রাণদায়ী বাতাসে। সে বাতাসেই ছিল হাফিজের শ্বাস-প্রশ্বাস। তাই ১৯৭১ সালে অবরূদ্ধ ঢাকায় বসে কী করতে হবে, সেটা কেউ এসে তাঁকে শিখিয়ে দিয়ে যায়নি। কাজগুলো যেন স্বতঃসিদ্ধের মতো তাঁর কাঁধে এসে ভীড় জমিয়েছিল। সে এক অদ্ভুত সময়। তখন যে কোনো মানুষই পরিণত হচ্ছিলেন এক একজন যোদ্ধায়। সে যুদ্ধের যে রকমফের ছিল কত, সে কথা কি আজকের দিনে এসে আর অনুভব করা যাবে?
আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে হাফিজ একবার গিয়েছিলেন লোকসঙ্গীতের গুরু আবদুল লতিফের কাছে। বহু আলাপ হয়েছিল সেখানে। একটু ভেবে দেখুন, দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে—এই তাড়নায় এই মানুষেরা অবরূদ্ধ নগরের একটি বাড়িতে বসে ফিসফিস করে কথা বলছে, আলোচনার বিষয় আর কিছু নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য নতুন গান। হ্যাঁ, সে গানগুলো লেখা হতে থাকে। যে কাগজে লেখা হতো গান, সে কাগজ পুড়িয়ে ফেলা হতো গানটি রেকর্ডিং-এর পরপরই। গানের কাজগুলো যখন হতো, তখন সে ঘরটিতে কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। গান হতো নিভৃতে। শুধু কয়েকজন মানুষ জানত, এখানে তৈরি হচ্ছে নতুন দিনের গান।

যারা বাজাতেন, তাদের নিয়ে আসার জন্য হাফিজ বেরিয়ে পড়তেন গাড়িতে করে। ভেবে দেখুন, একটি প্রায় অচল শহরে একটি গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। সেনা সদস্যদের নিশ্চয়ই কখনো কখনো সন্দেহ হতো। আর সে সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য হয়তো ‘ডান্ডি কার্ড’-এর ব্যবস্থা থাকত। ওরা পড়তে পারত কতোটা, তা ওরাই জানে। কিন্তু কার্ড দেখলে সমীহ করে ছেড়ে দিত।
হাফিজের কি ছিল এ রকম কোনো ‘ডান্ডি’ কার্ড? না থাকলে তিনি কি এভাবে চলতে পারতেন? গাড়িতে উঠছেন যন্ত্রীরা। কয়েকটা রাস্তা ঘরে যন্ত্রীদের নিয়ে হাফিজ চলে এসেছেন আউটার সার্কুলার রোডে আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে। এ যেন প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে গান।
সে গানগুলো এখন কোথায়? রেকর্ডগুলো কি ‘ওপারে’ পাঠানো সম্ভব হয়েছিল? কার কাছে ছিল? নাকি যেদিন হানাদারেরা আলতাফ মাহমুদসহ অনেককেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, সেদিনই গানের রেকর্ডগুলো জব্দ করে? এ সন্দেহ আসার কারণ হলো, টর্চার সেলে আলতাফ মাহমুদ আর হাফিজের ওপর যে নারকীয় অত্যাচার করা হয়েছিল, তা তাঁদের কাছে গোপন কোনো কিছুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল বলেও হতে পারে। এমন কি হতে পারে, সেই জব্দ করা গানগুলো বাজিয়ে শুনছে পাকি হানাদারেরা, তা তর্জমা করে দিচ্ছে তাদের এ দেশীয় দালালেরা? এবং তারপর নির্যাতনের জন্য ধেয়ে আসছে এই কুলাঙ্গারেরা?
এর পুরোটাই অনুমান। কিন্তু এই অনুমানের সঙ্গে সত্যের একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি এতোটা ভালোবাসা দেখলে কুলাঙ্গারদের তা ভালো লাগবে কেন?
নাকি সেই অস্ত্র ও গোলা বারুদের চারটি ট্র্যাঙ্কই আলতাফ মাহমুদ আর হাফিজের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল? ড্রাম ফ্যাক্টরির নির্যাতন কক্ষে সেই দিনগুলোয় কী ঘটেছিল, তার কিছু কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় নানা জনের লেখায়। হাফিজের কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখের কথা সে রকমই এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় বেরিয়ে আসে। কিংবা আলতাফ মাহমুদ আর হাফিজের ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে কেনই বা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মনে হবে, তারা মরে গেলেই বরং ভালো হতো। এই অত্যাচার সহ্য করার মতো নয়!

৩.
এই হাফিজকেই তো দেখছি ক্র্যাক প্লাটুনের উলান অপারেশনে। হ্যাঁ, গাড়িটায় তো তাকেই দেখা যাচ্ছে। গাজী গোলাম দস্তগীরের ওপর দায়িত্ব পড়েছে উলান অপারেশনের নেতৃত্ব দেওয়ার। স্ঙগে আছেন আরো কজন। কাজটা হলো ট্রান্সফর্মার উড়িয়ে দেওয়া। এলাকাটিকে বিদ্যুৎবিহীন করে দিতে হবে।

ঢাকা শহরের অন্তত ৫টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আঘাত হানার পর সে খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলে বিশ্ববাসী জানতে পারবে ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয়। যদি এই বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, তাহলে বোঝা যাবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নেই। ঢাকা আদতে এখন বাংলাদেশের রাজধানী। পাকিস্তানের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য তখন থেকেই চলছিল পরিকল্পিত তৎপরতা।


গাড়িতে হাফিজ বসে আছেন। কিন্তু অভিযানের কিছুক্ষণ আগে গাড়ি গেল বিগড়ে। এখন কী করা যায়! তিনটা রিকশায় সওয়ার হয়ে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সদস্যরা চলে গেল উলান ট্রান্সফর্মার উড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
এখানে বলে রাখা ভালো, মে মাসের দিকে বাঙালিদের তৎপরতা যেন পৃথিবীবাসী দেখতে পায়, সে রকম পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সে সময়ই গেরিলারা মে মানের শেষদিকে ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল।

ঢাকা শহরের অন্তত ৫টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আঘাত হানার পর সে খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলে বিশ্ববাসী জানতে পারবে ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয়। যদি এই বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, তাহলে বোঝা যাবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নেই। ঢাকা আদতে এখন বাংলাদেশের রাজধানী। পাকিস্তানের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য তখন থেকেই চলছিল পরিকল্পিত তৎপরতা।
তাদের এই পরিকল্পনা সফল হয়েছিল। দুই নম্বর সেক্টরের মাধ্যমেই আসলে গেরিলারা সংগঠিত হয়ে উঠেছিল এবং ঢাকায় এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল পাকিস্তানিদের বিশ্বাসের ভিৎ।
এই গেরিলা আক্রমণের একটা লক্ষ্য ছিল, বাঙালি যারা ঢাকা ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনি, তাদের মনোবল বাড়িয়ে তোলা। পাকিস্তানিদের ওপর হামলা হলে তারা জানতে পারবে, এই দেশে এই জুলুমের শাসন আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না।


হাফিজ এই গেরিলা দলের সঙ্গী হলেন। আলতাফ মাহমুদের বাড়িতেও বসতে লাগল গেরিলাদের বৈঠক।
হাটখোলা, দিলু রোড, ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের নির্দিষ্ট কিছু বাড়িতেও বসত গোপন বৈঠক। ক্র্যাক প্লাটুনের গল্প তো এভাবে শেষ করা যাবে না। শুধু এটুকুই এখানে বলে রাখি, এই গেরিলা বাহিনীর তৎপরতা সত্যিই আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুলেছিল। বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমসে খবরগুলো প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।
আগস্টের এক সন্ধ্যায় পর পর ছয়টি মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল ঢাকায়। সে ঘটনার অন্যতম হোতা হাফিজ।

৪.
মুক্তিযুদ্ধ শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো, তিনি একটি গোটা জাতিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। জীবনের সব নদী এসে মিলেছিল একটি সাগরের পারে, সে সাগরের নাম মুক্তি! আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে জীবনের মিল খুঁজছিল মানুষ। এবং ভাবছিল, দেশ হানাদার-মুক্ত হলে মানুষ পাবে সেই মুক্তির স্বাদ।
পরবর্তীকালে সে মুক্তি পুরোপুরি না এলেও পাকিস্তানি শোষণের জোয়ালটা নেমেছিল কাঁধ থেকে। সেটাও কম অর্জন নয়। কিন্তু সম্মিলিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা অধরাই রয়ে গেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিবেচনা করলে বীরের আত্মদানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু আজকের অবস্থান থেকে তো একাত্তরকে বিশ্লেষণ করলে হবে না। একাত্তরকে দেখতে হবে একাত্তরের বাস্তবতায়। সেখানে আমরা হাফিজকে পাই একজন মুক্তিকামী বাঙালি হিসেবে। যিনি সুরে মুহ্যমান এবং পাকিস্তানিদের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সোচ্চার। এ রকম মানুষেরা ছিল বলেই পাকিস্তানিরা পায়ের নিচে শক্ত মাটির ঠিকানা আর খুঁজে পায়নি।

এই শিশুরা যেন একটা নির্ভয় ভবিষ্যৎ পায়, তারই তো চেষ্টা ছিল হাফিজের। ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য সদস্যদের। ঢাকায় অবস্থানরত সাংবাদিকদের, চিকিৎসকদের, অন্যান্য চাকরিজীবীদের। ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ চলচ্চিত্রটিতে এইসব অবরুদ্ধ মানুষের জীবনকাহিনীর সন্ধান পাই আমরা। সন্ধান পাই ‘দ্য ট্রেন’ ছায়াছবিতে। শত্রুর সঙ্গে বসবাস করতে করতেই কীভাবে শত্রুকে নিকেশ করার পরিকল্পনা করছে তারা, সেটা দেখতে পাই। এই বড় ক্যানভাসে যখন হাফিজকে দেখি, তখন তাঁকে দেবদূত বলে মনে হয়।


একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে যারা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েছে, তাদের মধ্যে আমিও একজন। পাঁচ বছরের শিশুটি সে সময়ের সকল শিশুর মতোই খুব দ্রুত মানসিকভাবে বড় হয়ে উঠেছিল। সে সময়কার শিশুরা একলাফে শৈশব অতিক্রম করেছিল। টহলরত পাকিস্তানি সেনাদের সামনে দিয়ে কোনো অভিভাবকের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে সবজি, মাছ-মাংস কিনতে পারত তারা। লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে পারত। সাইরেন বাজলেই ঢুকে পড়তে পারত বাড়ির সামনে তৈরি করা ট্রেঞ্চে।

এই শিশুরা যেন একটা নির্ভয় ভবিষ্যৎ পায়, তারই তো চেষ্টা ছিল হাফিজের। ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য সদস্যদের। ঢাকায় অবস্থানরত সাংবাদিকদের, চিকিৎসকদের, অন্যান্য চাকরিজীবীদের। ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ চলচ্চিত্রটিতে এইসব অবরুদ্ধ মানুষের জীবনকাহিনীর সন্ধান পাই আমরা। সন্ধান পাই ‘দ্য ট্রেন’ ছায়াছবিতে। শত্রুর সঙ্গে বসবাস করতে করতেই কীভাবে শত্রুকে নিকেশ করার পরিকল্পনা করছে তারা, সেটা দেখতে পাই। এই বড় ক্যানভাসে যখন হাফিজকে দেখি, তখন তাঁকে দেবদূত বলে মনে হয়।
কিন্তু যে দুটো ছবির কথা বললাম, তা তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ভিনদেশী মানুষের কর্ম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে উঠে আসতে হবে এই ত্যাগের কথা।

৫.
বেশকিছু ভাষ্য আছে হাফিজের জীবন দান নিয়ে। নির্যাতনরত অবস্থায়ই হাফিজ শহীদ হন। যেমন বদিও শহীদ হয়েছিলেন। বদি একবার ইলেকট্রিকের তার পেঁচিয়েছিলেন শরীরে, একবার দৌড় দিয়েছিলেন, যেন পাকিস্তানিরা গুলি করে। কিন্তু বদির জন্য গুলি খরচ করতে চায়নি পাকিস্তানিরা। একজন বাঙালির জীবনের দাম কি একটা বুলেটের দামের চেয়ে বেশি? তাই নির্যাতন করেই হত্যা করেছিল তাঁকে।
কী এক ভয়াবহতা নেমে এসেছিল সে সময়!
৩০ আগস্টের সেই অভিশপ্ত দিনটিতে হাফিজ ধরা পড়েন তাঁর নিউ ইস্কাটনের বাড়ি থেকে। সেদিন বিকেলে প্রথম ধরা পড়েছিলেন সামাদ। তুখোড় এই গেরিলা সদস্য নিজের ওপর বিশ্বাস এবং দেশের প্রতি অটল শ্রদ্ধা রাখতে পারেননি। নির্যাতনের মুখে তিনি ফাঁস করে দিয়েছিলেন কারা কারা পাকিস্তানিদের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সামাদের মাধ্যমে গেরিলাদের ঠিকানা পেয়ে যায় বর্বর পাকিস্তানি সেনার দল। এবং তারা সামাদের সহযোদ্ধাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেপ্তার করতে থাকে। রুমি ধরা পড়ে, বদি ধরা পড়ে, আজাদ, জুয়েল ধরা পড়ে।
সামাদ সবচেয়ে বড় অন্যায় যেটি করেন, সেটি হলো তিনি আলতাফ মাহমুদের নামটি বলে দেন। দুদিন আগে সামাদই আর দুজন গেরিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে। সেখানে অস্ত্রভর্তি ট্রাঙ্ক পুঁতে রেখেছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের এই সরঞ্জাম গোপনেই থাকা উচিৎ ছিল। সামাদ সেই গোপনীয়তা ভঙ্গ করেছিলেন।
পাকিস্তানি গোয়েন্দারা আউটার সার্কুলার রোডের বাড়িতে এসে আলতাফ মাহমুদকে অকথ্য নির্যাতন করল। অস্ত্র কোথায় জানতে চাইল। আলতাফ মাহমুদ স্বীকার করলেন না অস্ত্রের কথা। এ সময় সামনে আনা হলো সামাদকে। এবার আর বুঝতে বাকি রইল না, সামাদ সব বলে দিয়েছে।
এরপর কী কী ঘটল, তা নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাব না। ক্র্যাক প্লাটুনের অমল যুবকদের ধরে নিয়ে কীভাবে তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছিল, সে বর্ণনা বহু জায়গায় পাওয়া যাবে। সে কথা লিখতে গেলেও কি-বোর্ডে আঙুল সরতে চায় না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এতগুলো অস্ত্র কেন পুতে রাখা হয়েছিল সেদিন আলতাফ মাহমুদের বাড়ির সামনে? একটু সময়টির দিকে নজর দিলেই জানা যাবে, সে সময় পাকিস্তানে কী ঘটছে, তা দেখার জন্য মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ঢাকায় আসার কথা ছিল। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালেই উঠবেন তিনি, এ রকম কথা হয়েছিল। কিন্তু ভারতে উদ্বাস্তু শিবির দেখেই এডওয়ার্ড কেনেডি বুঝে গিয়েছিলেন আসলে পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে। তাই তিনি আর ঢাকায় আসেননি। কিন্তু বিদেশিরা ঢাকায় আসছেন, তাদের সামনে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ঘটাতে হবে—এই ভাবনা থেকেই জোগাড় করা হয়েছিল অনেক অস্ত্র, গোলা বারুদ। তাঁরা না আসায় সেগুলোর অনেকটাই আর ব্যবহার হয়নি। তারই একটা অংশ পুতে রাখা হয়েছিল আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে। এবং এই সূত্র ধরেই পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল এই মুক্তিসেনাদের।
আমি যখন প্রথম শুনি, নির্যাতনের সময় হাফিজের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে গালের ওপর ঝুলছিল, তখন মুহূর্তের জন্য আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমার ভাবনায় এসেছিল রুমী, আজাদ, জুয়েল, বকর, বদির চেহারা। এবং সবশেষে হাফিজের সেই কোটর থেকে বেরিয়ে আসা চোখই আমাকে বলেছিল, ‘দেখো, আমার চোখ দিয়ে দুনিয়া দেখো। তাহলেই পাবে দেখার আনন্দ এবং আমাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভীষিকার ফ্ল্যাশব্যাক।’
হাফিজের চোখ দিয়ে মুক্তির দিশা খুঁজি আমরা। হাফিজের বেরিয়ে আসা চোখ দিয়েই যেন অনুভব করি স্বপ্নের মৃত্যু-যন্ত্রণা।
তাই এই চোখটাই হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাওয়া-না পাওয়ার মাপকাঠি। এবং এই চোখটাই যেন আমাদের পাহারা দেয়। জানিয়ে দেয়, যন্ত্রণার মাধ্যমে পাওয়া একটি মুক্তির স্বপ্নকে এভাবে নষ্ট করে দিতে নেই।

আরও লেখা

তুষারকন্যা
শিশু ও কিশোর সাহিত্য

তুষারকন্যা

রুশদেশের উপকথাঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ি। ভালোই তো ছিল

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top