নিকোলাই নোসভ
রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
চাপাবাজ
নিকোলাই নোসভ
রুশ থেকে অনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর
মিশুৎকা আর স্তাসিক বাগানের বেঞ্চিতে বসে কথা বলছিল। কিন্তু সে কথাগুলো সাধারণ কথা ছিল না। অন্য বাচ্চারা এ আলাপ করতেই পারবে না। কে কাকে মিথ্যে বলায় হারিয়ে দিতে পারে, সেই প্রতিযোগিতায় বুঝি নেমেছিল ওরা।
‘তোর বয়স কত?’ মিশুৎকা জিজ্ঞেস করল।
‘আমার বয়স পঁচানব্বুই। আর তোর?’

‘আমার বয়স একশো চল্লিশ।’ বলল মিশুৎকা। ‘ আগে আমি অনেক অনেক বড় ছিলাম, লম্বা ছিলাম, একেবারে বোরিয়া কাকুর মতো। পরে ছোট হয়ে গেছি।’
‘আর আমি’ বলতে শুরু করল স্তাসিক, ‘শুরুতে ছিলাম খুব ছোট, তারপর বড় হতে শুরু করেছি। এরপর আবার ছোট হয়েছি, কিছুদিন পর আবার বড় হব।’
‘আমি যখন বড় ছিলাম, তখন পুরো নদীটা সাঁতরে এপার–ওপার করতে পারতাম!’ বলল মিশুৎকা।
‘বললি একটা কথা! আর আমি পুরো সমুদ্র পাড়ি দিতে পারতাম!’ বলল স্তাসিক।
‘সমুদ্র। ফু! আমি মহাসাগর পাড়ি দিতাম।’ বলল মিশুৎকা্।

‘আমি আগে উড়তে জানতাম।’
‘এখন তাহলে উড়ে দেখা!’
‘এখন উড়তে পারব না্ উড়তে ভুলে গেছি।’

বা ‘আমি একবার সমুদ্রে সাঁতার কাটছিলাম। এ সময় একটা হাঙর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। আমি হাঙরটাকে ঘুষি মারলাম! হাঙরটা মস্ত হা করে আমার মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল।’
‘মিথ্যে বলছিস!’
‘একদম সত্যি!’

‘তাহলে তুই মরে যাসনি কেন?’
‘কেন আমাকে মরতে হবে? আমি সাঁতরে সমুদ্রতীরে ফিরে এলাম তারপর বাড়ি গেলাম।’
‘মাথা ছাড়া?’
‘হ্যাঁ, মাথা পাব কোথায়? আমার মাথার দরকারই বা কী?’
‘মাথা ছাড়া কী করে হেঁটে গেলি?’
‘যেভাবে মানুষ হেঁটে বাড়ি যায়, সেভাবেই গেছি। এমনভাবে বলছিস, যেন মনে হচ্ছে, মাথা ছাড়া হাঁটা নিষেধ!’
‘এখন আবার মাথা এল কোত্থেকে?’
‘নতুন মাথা গজিয়েছে।’
‘ভেবেছে ভালোই’ মনে মনে স্বীকার করে নিল স্তাসিক। স্তাসিকের ইচ্ছে হলো মিশুৎকার চেয়েও বড় চাপাবাজি করবে।
‘এটা আর এমন কী?’ বলল স্তাসিক। ‘একবার আমি যখন আফ্রিকায় গিয়েছিলাম, তখন আমাকে কুমীর খেয়ে ফেলেছিল।’

চাপাবাজি!’ ফিক করে হেসে বলল মিশুৎকা।
‘একদম চাপাবাজি না।’
‘তুই তাহলে কীভাবে বেঁচে আছিস?’
‘কুমীর তো আমাকে গিলতে পারেনি। বমি করে দিয়েছে।’

মিশুৎকা নতুন গল্প ভাবতে লাগল। স্তাসিকের চেয়ে বড় চাপাবাজি করার ইচ্ছে হলো তাঁর। ভাবল ভাবল। শেষে ভেব বেরও করল। বলল, ‘একদিন আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। চারদিকে ট্রাম, গাড়ি, ট্রাক…’
‘জানি জানি!’ চেঁচিয়ে উঠল স্তাসিক। ‘ তুই এখনই বলবি, কীভাবে ট্রাম তোর উপর দিয়ে চলে গিয়েছিল! তুই এই চাপাবাজিটা আগেও করেছিস!’
‘একদম না। আমি সে ঘটনার কথা বলছি না।’
‘ঠিক আছে, চাপাবাজিটা করে ফ্যাল!’
‘আমি হাঁটছি, কারো কোনে ক্ষতি করছি না। এ সময় ধেয়ে এল একটা বাস। আমি সেটা লক্ষ্য করিনি। আমি পা চালিয়ে দিলাম বাসের ওপর! বাস চিরে চ্যাপটা হয়ে গেল রুটির মতো!’

‘হাহ হাহ হা! চাপাবাজি!’
‘তুই তোর পা দিয়ে কীভাবে একটা বাসকে পিষে ফেলতে পারিস? চাপা!’
‘আরে সেটাই তো বলছি। বাসটা তো ছিল একেবারেই ছোট। ওটা ছিল খেলনা বাস। দড়ি দিয়ে ওই বাসটা টেনে িনয়ে যাচ্ছিল একটা বাচ্চা।’
‘এ আর এমন কী! আমি একবার চাঁদে গিয়েছিলাম।’ বলল স্তাসিক।
‘এই শুরু হলো!’ হেসে বলল মিশুৎকা।
‘বিশ্বাস করিস না? কসম খেয়ে বলছি!’
‘কিসে চড়ে গেলি চাঁদে?’
‘কিসে আবার! রকেটে। রকেট ছাড়া কি চাঁদে যাওয়া যায়? মনে হয়, এটা তুই জানিস না!’
‘চাঁদে তুই কী দেখলি?’
‘কী দেখলাম?’ হাসল স্তাসিক। ‘আমি কী দেখলাম চাঁদে? আমি সেখানে কিছুই দেখিনি!’‘হাহ হাহ হা!’ জোরে হেসে উঠল মিশুৎকা। ‘কিছুই দেখিসনি, কিন্তু বলছিস, তুই চাঁদে গিয়েছিলি!’
‘গেছিই তো!’
‘তাহলে কিছুই দেখিসনি কেন?’
‘আরে তখন সেখানে অন্ধকার। আমি তো রাতের বেলায় গিয়েছিলাম। স্বপ্নে। বরেকেট চড়ে বসলাম, মহাশূন্যে উড়তে লাগলাম। এরপর এদিক গেলাম, সেদিক গেলাম। তারপর ফিরে এলাম পৃথিবীতে…আর তখনই আমার ঘুম ভেঙে গেল!’

মিশুৎকা বলল, ‘সেটাই আগে বলতি যে ঘুমের মধ্যে গেছিস!’
তখন সেখানে হাজির হলো পাড়ার ছেলে ইগর, বসল ওদেরই পাশে, একই বেঞ্চিতে। ইগর মিশুৎকা
আর স্তাসিকের কথা শুনতে লাগল। তারপর একসময় বলল,‘ তোরা দুজনই চাপাবাজি করছিস! তোদের লজ্জা করে না?’
‘লজ্জা কিসের? আমরা তো কারো কাছে গিয়ে মিছে কথা বলছি না। আমরা নিজেদের মতো করে কল্পনা করছি! অনেকটা রূপকথার মতো। রূপকথার গল্প বলছি!’ বলল স্তাসিক।
‘রূপকথা! খুব একটা কাজ খুঁজে পেয়েছে!’ শিস দিয়ে বলে উঠল ইগর।
‘তুই ভেবেছিস, কল্পনা করা খুব সহজ কাজ?’
‘সহজই তো!’
‘ঠিক আছে। কিছু একটা ভেবে দেখা!’
‘এখনই ভেবে দেখাচ্ছি!’ বলল ইগর।
খুবই খুশি হয়ে স্তাসিক আর মিশুৎকা ইগরের কল্পনা শোনার জন্য কান খুলে রাখল।
‘এই যে বলছি, অ্যা…অ্যা… অ্যা.. হমম অ্যা… অ্যা… অ্যা…
‘তুই শুধু অ্যা আর হমম ভাবতে পারলি?’
‘আরে দাঁড়া, একটু ভাবতে দে!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভেবে বের কর!’
‘অ্যা…অ্যা…অ্যা…এই যে বলছি, এখনই বলছি, অ্যা…অ্যা…অ্যা…’ আবার বিড়বিড় করতে লাগল ইগর।
‘কেন তুই কল্পনা করে কিছু বলতে পারছিস না? এই তো বললি, এটা একেবারে সহজ!’
‘শোন, একবার আমি একটা কুকুরকে বিরক্ত করেছিলাম। কুকুর আমার পা কামড়ে দিয়েছিল!’
‘এখানে কল্পনা কোথায়?’ জানতে চাইল স্তাসিক।
‘না, এখানে কল্পনা নেই, যা ঘটেছিল, তা–ই বললাম।’

‘আর বলছিল, কল্পনার মাস্টার তিনি!’
‘হ্যাঁ, আমি মাস্টারই তো! কোনো কারণ ছাড়াই তোরা মিথ্যা বলিস! কাল আমি মিথ্যে বলেছিলাম, কিন্তু তাতে আমার লাভ হয়েছে!’
‘লাভ?’
‘শোন, কাল সন্ধ্যায় মা আর বাবা বাইরে গেল। আমি আর ইরা ছিলাম বাড়িতে। ছোট বোনটা ঘুমাতে গেল। আমি চলে এলাম রান্নাঘরে। তারপর বয়াম খুলে খেয়ে নিলাম আধ বয়াম ফলের জেলি। তারপর ভাবলাম, মা এসে তো মারবে আমাকে। তখন আমি ইরার ঠোঁটে লাগিয়ে দিলাম সেই জেলি। মা এসে জিগ্যেস করল, ‘কে জেলি খেয়েছে?’ আমি বললা, ইরা। মা দেখল, ইরার ঠোঁটে জেলি। আজ সকালো মা ওঁকে অ্যায়সা পেঁদিয়েছে! আর মা আমাকে ফলের জেলি দিয়েছে বেশি করে। বুঝলি তো, কীভাবে আমার লাভ হলো!’
‘মানে, তুই বলতে চাস, তোর কারণে অন্য একজন শাস্তি পেল আর তাতে তুই খুশি হলি?’ মিশুৎকা অবাক হয়ে জানতে চাইল।
‘তাতে তোর কী?’
‘আমার কিছু না। কিন্তু আমি বলতে পারি, তুই একটা…তুই একটা…শয়তান! বুঝলি?’
‘তোরা শয়তান!’
‘পালা এখান থেকে! তোর সঙ্গে এক বেঞ্চিতে বসতে চাই না।’
‘আমিই তোদের সঙ্গে বসতে চাই না!’

ইগর বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল, তারপর চলে গেল। মিশুৎকা আর স্তাসিকও বাড়ির পথে রওনা হলো। পথে পড়ল আইসক্রিমের দোকান। ওরা তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। সবগুলো পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজল, যদি পয়সা মেলে! শেষে দুজনের পকেট থেকে যে পয়সা পাওয়া গেল, তা দিয়ে একটা আইসক্রিম কেনা যায়।
‘একটাই কিনি আয়, তারপর অর্ধেক করে খেয়ে নেব।’ প্রস্তাব দিল স্তাসিক।
দোকানদার মহিলা ওদের হাতে একটা আইসক্রিম তুলে দিলেন।
‘চল বাড়ি যাই। সেখানেই দুইভাগ করব। তাহলে ভাগদুটো একেবারে সমান সমান হবে।’ বলল মিশুৎকা।
‘চল।’
বাড়ি যাওয়ার পথে সিঁড়িতে দেখা হলো ইরার সঙ্গে। ইরার চোখে পানি। কেঁদেছে ও।
‘তুই কেঁদেছিস কেন?’ জিগ্যেস করল মিশুৎকা।
‘মা আমাকে বাইরে খেলতে যেতে দেয়নি।’
‘কেন?’
‘ফলের জেলির জন্য। আমি জেলি খাইনি। মায়ের কাছে ইগর লাগিয়েছে। মনে হয়, ইগর খেয়ে আমার নাম দিয়েছে।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ইগরই খেয়েছে। আমাদের ও সে কথা বলেছে। তুই কাঁদিস না। আমি আমার ভাগের আইসক্রিমের অর্ধেকটা তোকে দেব।’ বলল মিশুৎকা।
‘আমার ভাগের অর্ধেকটাও তুই পাবি।, একবার শুধু চাটব, তারপরই পুরোটা তোর।’ বলল স্তাসিক।

‘তোমরা খাবে না?’
‘না না খাব না। আজ আমরা দশটা করে আইসক্রিম খেয়েছি!’ বলল স্তাসিক।
‘এসো, এই আইসক্রিমটা আমরা তিন ভাগে ভাগ করি।’ প্রস্তাব করল ইরা।
‘একদম ঠিক! তা না হলে গোটা আইসক্রিম খেয়ে তোর গলা ব্যথা করবে।’ সায় দিল স্তাসিক।
ওরা বাড়িতে এল, তিনভাগে ভাগ করল আইসক্রিম।
‘খুব মজা!’ বলল মিশুৎকা। ‘আইসক্রিম খেতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি একদিন এক বালতি আইসক্রিম খেয়েছিলাম!’
‘তুই চাপাবাজি করছিস!’ হাসতে হাসতে বলল ইরা। ‘কে বিশ্বাস করবে যে তুই এক বালতি আইসক্রিম খেয়েছিস?’
‘আরে বালতিটা তো খুব ছোট ছিল, একেবারে ছোট। একটা গ্লাসের সমান…’

শেষ
এঁকেছেন: ই. সিমিওনোভা