নিউইয়র্কের সাহিত্যিকেরা | জাহীদ রেজা নূর

নিউইয়র্কের সাহিত্যিকেরা

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

পৃথিবীর আর কোনো শহরের সঙ্গে মেলানো যাবে না নিউইয়র্ককে। শহরের শুরু যখন, তখন থেকেই এর হৃদস্পন্দন একই রকম খেলোয়াড়ি। খেলোয়াড় দৌড়ায় বলে তার হৃৎপিণ্ড সর্বদাই লাফাতে থাকে। নিউইয়র্কের হৃৎপিণ্ডও সবসময় দ্রুতগতিতে লাফিয়ে যাচ্ছে। এতোটা জীবন্ত শহর পৃথিবীতে কম দেখা যায়।

এর কারণ বোঝা খুব কঠিন কিছু নয়। প্রতিদিনই এ শহরে নতুন সদস্যরা আসছে। যোগ হচ্ছে নতুন রক্ত। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশ–মহাদেশ থেকে এ শহরে মানুষ আসছে। প্রতিদিন তারা নিয়ে আসছে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন ইতিহাস, নতুন সংস্কৃতি। এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তা। সম্প্রদায়গত মিলন হচ্ছে, আবার অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গেও মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে নতুন সংস্কৃতি। এ এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা।

একটা সামগ্রিক নিউইয়র্ক খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। এখানে বাঙালি নিউইয়র্কের পাশাপাশি ইতালিয়ান, জাপানি, চায়নিজ, রুশ, আয়ারল্যান্ডের নিউইয়র্ক আছে। লাতিন আমেরিকা থেকে পাড়ি দেওয়া বিভিন্ন দেশের মানুষ দিয়ে গড়া হিস্পানিক নিউইয়র্ক আছে, আছে আফ্রিকান নিউইয়র্ক। প্রতিটি নিউইয়র্কই জীবন্ত। আর সেই জেগে থাকা নিউইয়র্কই প্রতিমুহূর্তে সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে চলেছে।

এই নিউইয়র্ক একসময় সাহিত্যিক আমেরিকাকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতার প্রথম ফসল হিসেবে যে তিনজন লেখকের নাম করা হয়, সেই ওয়াশিংটন আর্ভিং, জেমস ফেনিমুর কুপার এবং এডগার অ্যালান পোর নিজস্ব শহর হিসেবে এই নিউইয়র্কের নামই বলতে হয়। আমরা এখানে স্মৃতির ঝলকে দেখে নেব এই লেখকদেরই কয়েকজনকে। অনুভব করার চেষ্টা করব, একদা কোনো না কোনো সময় এরাই একসময় শাসন করে বেরিয়েছে নিউইয়র্ক।

অতীতে খোঁজ

ব্রিটেনের কাছ থেকে আলাদা হওয়ার জন্য সে কি ব্যস্ততা ছিল মার্কিনীদের। সেই আলাদা হওয়ার ধারণা থেকেই গড়ে উঠেছিল আমেরিকান সাহিত্য।যারা সে আমেরিকান সাহিত্যের পথিকৃত, তাদেরই কয়েকজন ছিলেন এই শহরে। এখানে বসেই সৃষ্টি করেছেন তাঁদের অসাধারণ সব রচনা। এই শহরের সঙ্গে মিশে আছে ওয়াল্ট হুইটম্যান, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়াম, ডিলান টমাস, ফ্রাঙ্ক ওহারার মতো সাহিত্যিকদের নাম।

হুইটম্যান ছিলেন ব্রুকলিনে, নিউজার্সিতে আর লং আইল্যান্ডে। হ্যাঁ, নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের বারগুলো ছিল তাঁর পদচারণায় মুখর। তবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে কি না করেছেন তিনি! আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেছেন, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় হাসপাতালের পুরুষ নার্স হিসেবে কাজ করেছেন। নিউইয়র্কের সমুদ্রের বাতাসে তিনি নিশ্বাস নিয়েছেন। এখানেই তিনি কবিতা লিখেছেন। হ্যাঁ, মুক্তছন্দে কবিতা লিখে নাম কুড়িয়েছেন হুইটম্যান। হুইটম্যানের সঙ্গে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও তুলনা করা হয়। বাংলা ভাষায়ই পাওয়া যাবে তাঁদের নিয়ে অনেক লেখার সন্ধান।

এডগার অ্যালান পো থাকতেন বাল্টিমোরে। এরপর থেকেছেন রিচমন্ডে। তবে জীবনের কিছূ অংশ তিনি কাটিয়েছেন ম্যানহাটনে। হ্যাঁ, সেই ম্যানহাটনে, যেখানে এখন প্রাণের জোয়ার। বিশ্বের সেরা সাংস্কৃতিক হৃদয়ের প্রকাশ ঘটে যেখানে। ম্যানহাটনের আপার ওয়েস্টসাইডে থেকেছেন তিনি। এখানেই একটি ছোট বাড়ি ছিল তাঁর। তিনি বেড়াতে যেতেন রিভারসাইড পার্কে। আমরা যখন সে পার্কে যাই, তখন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি এ কথা ভেবে যে, একদা কোনো একদিন এডগার পো হেঁটেছিলেন এই পথ ধরে। এডগার অ্যালান পোর গোয়েন্দা বা রহস্য গল্পগুলোর কথা অনেকেরই মনে পড়ে যাবে। ‘কালো বেড়াল’, আসার বংশের পতন’, ‘রু মর্গের রহস্য’ গল্পগুলো এখনও মনে আছে আমার। ‘দাঁড়কাক’ কবিতাটিও অসাধারণ। বোদলেয়ার অ্যালান পো দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, এ রকম কথা পড়েছি কোথাও। ফরাসী সাহিত্যের নামকরা অনেক সাহিত্যিকই মার্কিন সাহিত্যিকদের মধ্যে এডগার পোর নাম করেন সবার আগে।

কিছু ঐতিহাসিক জায়গা

সাহিত্যিক ছেড়ে সাহিত্যিকদের আশ্রয়স্থল, তাদের সাহিত্যকীর্তির ভরসাস্থল কিছু জায়গা নিয়ে কিছু বলি এবার।

‘পিটস ট্যাভার্ন’ নিয়েই কথা শুরু করা যাক। নিউইয়র্কের প্রাচীনতম পাবের একটি এটি। ১৮৬৪ সালে এটি খোলা হয়। এখানে আড্ডা বসে নানা ধরনের মানুষের। সাংবাদিক, বেসবল খেলোয়াড়দের আড্ডা তো থাকেই, তবে সাহিত্যিকদের আড্ডা দিয়েই এই পাব জমজমাট ছিল বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে।এদের নিজস্ব বিয়ারে ঠোঁট ভিজিয়েছেন বিখ্যাত অনেক মানুষ। পাবে ঢুকতেই দ্বিতীয় যে টেবিল, সেটায় বসে বিখ্যাত মার্কিন লেখক

ও হেনরি নিউইয়র্ক নিয়ে তাঁর ছোট গল্পগুলো লিখেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। এমনকি ‘গিফট অব দ্য মেজাই’ গল্পটিও এখানে বসে লেখা বলে দাবি করা হয়। ৫৫  ইরভিং প্লেসে ১৯০৩ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত থেকেছেন ও হেনরি।‘পিটস ট্যাভার্ন’ এখনও রয়েছে ম্যানহাটনে। পাবের সামনে ‘পিটস ট্যাভার্ন, ও হেনরি মেড ফেমাস’ লেখা আছে সাইনবোর্ডের মতো করে। ম্যানহাটনের ১৮ স্ট্রিটে ইরভিং প্লেসের কোনায় পাওয়া যাবে পাবটি। একটি কথা না বলে পারা গেল না। খাদ্যরসিক এক ব্যক্তি পিটস ট্যাভার্নের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘এখানে ড্রেসকোড আছে?’ পিটস ট্যাভার্ন থেকে উত্তর দেওয়া হয়েছে। ‘আছে। কাপড় পরুন এবং আসুন।’

আইরিশ ‘ম্যাকসোরলিস’ বারেরও রয়েছে নিজস্ব বিয়ার। ১৮৫৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যাডওয়ার্ড এস্টলি কামিংস আসতেন এখানে।এই তো, সেপ্টেম্বরের তিন তারিখে ছিল তাঁর মৃত্যুদিন। ১৯৬২ সালের এইদিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (কামিংস–এর জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৪ অক্টোবর) । বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকে লেখা তাঁর একটি কবিতায় আছে, “I was sitting at ‘mcsorley’s  পংক্তিটি। কামিংস এবং তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুরা সাধারণত বসতেন লোহার চুল্লির পাশের টেবিলে। বলা হয়ে থাকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সাগর পাড়ি দিয়ে ইয়োরোপে যুদ্ধ করতে যাওয়ার প্রস্তুতির সময়টিতে মার্কিন সৈন্যদের অনেকে এই টেবিলে বসতেন। সেখানে বসে বিয়ার খেতেন। শেষ পাত্র বিয়ার খাওয়ার পর নিজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে এক একটি চিরকুট লিখে বারের বিশাল আয়নার কাছে রাখতেন। জনশ্রুতি আছে, সেই আয়নার সামনে এখনও এমন অনেক চিরকুট পড়ে আছে, যার লেখকেরা বিশ্বযুদ্ধের পর আর নিউইয়র্কে ফেরেননি। যুদ্ধেই শেষ হয়েছে তাঁদের জীবন। ম্যাকসোরলিসে এখনও ক্রেডিট কার্ড নেওয়া হয় না। খাওয়া–দাওয়া সব ক্যাশ টাকায় করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো অনেক তাজ্জব ব্যাপারের সাক্ষী। ম্যাকসোরলিসও সে রকম কিছু আজব কাণ্ড ঘটিয়েছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই পাব ছিল নারীদের জন্য নিষিদ্ধ। ১৯৬৯ সালে দুজন নারী অ্যাটর্নি এই পাবে ঢুকতে চাইলে তাঁরা বাধার মুখে পড়েন। তখন তাঁরা এই বৈষম্যের অবসানের লক্ষে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। সে মামলায় ম্যাকসোরলিস হেরে যায় এবং ১৯৭০ সালের ১০ আগস্ট থেকে নারীরা এখানে প্রবেশাধিকার পান। কিন্তু মেয়েদের জন্য তখন আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করা হয়নি। নারী–পুরুষ একই বাথরুমে যেত। নারী প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হওযার ১৬ বছর পর নারীদের জন্য আলাদা বাথরুম হয়েছিল।

এই পাবে পা রেখেছিলেন অ্যাব্রাহাম লিংকন, ইউলিসিস এস গ্র্যান্ট, টেডি রুজভেল্ট, পিটার কুপারের মতো মানুষেরা। সাহিত্যিক ও শিল্পীদের মধ্যে আছেন হান্টার এস থমসন, ব্রেন্ডান বেহান, পল ব্ল্যাকবার্ন, ক্রিস্টোফার মার্লি, গিলবার্ট সারেন্টিনো, ডাস্টিন হফম্যান প্রমুখ।

এই পাব নিয়ে অনেক শিল্পকর্ম আছে। এর মধ্যে ১৯১২ সালে জন স্লোয়ানের আঁকা চিত্রকর্মটি রয়েছে ডেট্রয়েট ইনস্টিটিউট অব আর্টে।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি হায়ার ম্যানহাটনের বারগুলোয় ছিল দরিদ্র কবিদের আড্ডা। অ্যালেন গিনসবার্গ, উইলিয়াম বেরুজ, জ্যাক কেরুয়াক, গ্রেগরি কারসোকে দেখা যেত সে আসরে। বিট আন্দোলনের এই নেতারা পরে পেয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি।এই এলাকার ‘সান রেমো, গ্রিনউইচ ভিলেজ, ইউনিভার্সিটি প্লেস, হোয়াইট হর্স—এই ছিল বিট আন্দোলনের নেতাদের পানশালাগুলো। ওয়েলসের বিখ্যাত কবি ডিলান টমাস আসতেন এই অঞ্চলে। এখানকার ‘হোয়াইট হর্স’ পানশালায় তিনি পানাহার করতেন। এবং তার মৃত্যুও হয়েছে এই পানশালার কাছাকাছি।

হোটেল চেলসি বা চেলসি হোটেল নিয়ে একটি আলাদা লেখাই লিখতে হবে। নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক জীবনে এই হোটেলের রয়েছে বড় অবদান। পাশাপাশি এই হোটেলে সংস্কৃতিসেবীদের আত্মহত্যা বা মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। ম্যানহাটনের সেভেন্থ ও এইটথ অ্যাভিনিউ আর ২২২ ওয়েস্ট ২৩ স্ট্রিটে হোটেলটি। হো্টেলটি নিউইয়র্কের একটি দর্শনীয় স্থান।

অসংখ্য সাহিত্যিক, সংগীতসাধক, শিল্পী এবং অভিনয়শিল্পী থেকেছেন এখানে। দীর্ঘদিনের জন্য হোটেল রুম ভাড়া করে থেকেছেন অনেকে।আর্থার সি ক্লার্ক ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’ লিখেছিলেন চেলসিতে থাকার সময়। অ্যালেন গিনসবার্গ আর গ্রেগরি করসো তাদের দার্শনিক ও শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনার জন্যও বেছে নিয়েছিলেন এই হোটেলটিকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধেক জীবন’ আর ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বই দুটিতে এই দুই বিট কবির ব্যাপারে অনেককিছুই লেখা আছে। ২০১১ সালের ১ আগস্ট থেকে হোটেলটি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। নবীনীকরনের কাজ চলছে। এ বছরই চেলসির দ্বার খুলে দেওয়া হবে বলা হয়েছে।

এই হোটেল যে সাহিত্যিকদের পদচারণায় মুখর হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন মার্ক টোয়েন, ও হেনরি, ডিলান টমাস, আর্থার সি ক্লার্ক, স্যাম শেপার্ড, আর্থার মিলার, টমাস উলফ, সিমোন দ্য বোভার, ঝাঁ পল সাত্রর, আর কে নারায়ন প্রমুখ।

হার্ট কেইন, ফ্রাঙ্ক ওহারা, এলিজাবেত বিশপের মতো সাহিত্যিকেরা এই হোটেলে মারা যান।

 এ রকম অনেক কাহিনী আছে নিউইয়র্কজুড়ে। অতীত ও বর্তমান মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এখানে। এবং এখনও নতুর রক্ত এসে মিশে যাচ্ছে শহরে। শহরকে করে তুলছে প্রাণবন্ত। বাঙালিরা চেষ্টা করছে তাদের মতো করে একটি সাহিত্যিক নিউইয়র্ক গড়ে তুলতে, তেমনি রুশ, আফ্রিকান, লাতিন আমেরিকান, জাপানিসহ অভিবাসী জাতিগুলোও একই রকমভাবে সাহিত্যাঙ্গনে তৎপর। তবে এদের মধ্যে ইংরেজিতে না লিখে নিজ ভাষায় লেখার প্রবণতাই দেখা যায় বেশি। সেটাও আরেক রকম অর্জন এই নিউইয়র্কের। এখানে গড়ে উঠছে ফেলে আসা সংস্কৃতির প্রতি অবিচল আস্থাশীল মানুষের প্রাণের উচ্ছাস। মূল স্রোতধারাকেও তা মাঝে মাঝে আঘাত করে।

আরও লেখা

তুষারকন্যা
শিশু ও কিশোর সাহিত্য

তুষারকন্যা

রুশদেশের উপকথাঅনুবাদ: জাহীদ রেজা নূর এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ি। ভালোই তো ছিল

krac
মুক্তিযুদ্ধ

হাফিজের চোখ

জাহীদ রেজা নূর হাফিজের কথা ভাবলে প্রথমেই মাথায় পুর্ণতা পায় একটা ছবি—একজন মানুষ চোখ বন্ধ

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top