যে তিনটি সিনেমা নিয়ে আজ কথা বলব, আমি জানি না, সেগুলো যুদ্ধ নাকি ভালোবাসার ছবি। তিনটি ছবিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত। যুদ্ধ নিয়ে আমি যে চলচ্চিত্রগুলো দেখেছি, তার মধ্যে ভালোলাগার তালিকায় এই তিনটির অবস্থান একেবারে ওপরের দিকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি এই ছবিগুলো একসময় খুব দেখা যেত রুশ সংস্কৃতি কেন্দ্রে। ছবিগুলোর একটাতেও সমাজতন্ত্রের প্রচারণা ছিল না। নির্ভার কাহিনী এগিয়ে গেছে চলচ্চিত্রের ভাষায়। এমন সরল ভাষায় নির্মিত, কিন্তু এতোটাই লক্ষ্যভেদী, যে কখনো কখনো দর্শক মিশে যেতে পারেন ছবির কোনো কোনো চরিত্রের সঙ্গে।
যে ছবিগুলোর কথা বলছি, খুঁজলেই সেগুলো পাওয়া যাবে অন্তর্জালে। আমি রুশ ভাষায় দেখি মসফিল্মের একটি সাইটে। ইউটিউড, এফমুভিজসহ আরো অনেকখানেই ছবিগুলো দেখে নিতে পারবেন।
প্রথমেই বলি আলিওশার কথা। ছবিটির নাম ব্যালাড অব এ সোলজার। ওই ছোকড়া সৈনিকটি এক খণ্ডযুদ্ধে দুটি ট্যাংক নষ্ট করে দিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে নাৎসীদের। অধিনায়ক তাঁকে পুরস্কার দিতে চান। ছেলেটি জানায় তার অভিপ্রায়ের কথা। মাত্র ছয়দিন সময় পেলে ও দেখে আসতে পারে মাকে। অধিনায়ক ওকে ছুটি দেন। মায়ের জন্য উপহার কেনে ছেলে। সহজেই পৌঁছে যাওয়া যেত মায়ের কাছে, বেশ বড় একটা সময় নিয়ে থাকাও যেত মায়ের কাছাকাছি, কিন্তু যাওয়ার পথে ট্রেনে বিমান আক্রমণ, মানুষকে বাঁচানো, পঙ্গু সৈনিকের পারিবারিক জীবনে শান্তি ফিরিয়ে দেওয়া এবং অল্পসময়েই শুরা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম ইত্যাদি গ্রামে পোঁছুতে দেরি করিয়ে দেয়। দর্শকের মনে উত্তেজনা বাড়তে থাকে, দেখা হবে তো মায়ের সঙ্গে আলিওশার?
১৯৫৯ সালে নির্মিত গ্রিগরি চুখরাইয়ের এই ছবিতে কোনো মেলোড্রামাটিক দৃশ্য নেই। কিন্তু কেন কখন চোখ ভিজে যাবে জলে, কেন ভালোবাসার প্রথম পরশে উদ্বেলিত তরুণ–তরুণীর জন্য বুক ভরে যাবে আবেগে, সে কথা দর্শক বুঝতেই পারবে না। ছবি শেষ হলে যুদ্ধের ভয়াবহতা, শান্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি মনকে কেড়ে নেবে। কিন্তু এ বিষয়ে একটি শব্দও খুঁজে পাওয়া যাবে না ছবিতে।
ক্রেইনস আর ফ্লাইং বা বলাকারা উড়ে যায় ছবিটি ১৯৫৭ সালে নির্মাণ করেছিলেন মিখাইল কালাতাজোভ। বরিস আর ভেরোনিকার প্রেম দিয়েই ছবির শুরু। সারা মস্কো চষে বেড়ায় ওরা। আকাশে বলাকাদের উড়তে দেখে। সেদিন বেড়ানোর সময় ওরা বুঝতেই পারছিল না, সময় কোথা দিয়ে চলে গেছে। ঘড়ি যখন ঢং ঢং করে জানতে চাইল, এখনও কি বাড়ি ফেরার সময় হয়নি, কেবল তখনই ওরা সচকিত হয়ে দেখল ভোর ৪টা বেজে গেছে। তারিখ ২২ জুন, ১৯৪১। সেদিনই যুদ্ধ হলো শুরু। ভেরোনিকার জন্মদিনের একদিন আগেই বরিস স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে। যাওয়ার আগে খাঁচায় বন্দি একটা কাঠবেড়ালি উপহার দিয়ে যায় ভেরোনিকাকে। খাঁচায় থাকে ভেরোনিকার জন্য একটি চিঠি। সেটা ভেরোনিকার চোখে পড়ে না।
এরপর যুদ্ধ শুরু হয়। মস্কোতে বোমাবর্ষণ হয়। ভেরোনিকার বাবা–মা নিহত হন। বরিসের বাবা ফেওদর ইভানোভিচ ভেরোনিকাকে তাঁর বাড়িতে এসে থাকতে বলেন। বরিসের চাচাতো ভাই মার্কও থাকে সেই বাড়িতে। বরিসের খোঁজ মেলে না। একসময় ভেরোনিকা বাধ্য হয় মার্ককে বিয়ে করতে। অসাধারণ পিয়ানো বাজায় মার্ক। কিন্তু আদতে সে ভালো মনের মানুষ নয়। যুদ্ধের মাঠে ভেরোনিকাকে নিয়ে অশ্রাব্য কথা বলায় একজন সৈনিকের নাকে ঘুষি বসিয়ে দেয় বরিস। ভেরোনিকা অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। বরিসকে দেওয়া কথা রাখতে পারেনি বলে আত্মহত্যাও করতে চায়। এরপর কী হয়, তা বলা যাবে না। বেশ জটিল পথেই কাহিনি এগিয়ে যেতে থাকে। একসময় বরিসের লেখা সেই চিরকুটটিও হাতে আসে ভেরোনিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে এই ছবিটিকে অন্যতম সেরা ছবি বলা হয়।
দ্য ডনস হেয়ার আর কোয়াইট ছবিটির নাম। ১৯৭২ সালে নির্মিত। স্তানিস্লাভ রাস্তোৎস্কি তৈরি করেছেন ছবিটি। ১৯৬৯ সালে বরিস ভাসিলিয়েভের লেখা উপন্যাসটি বের হয় ইউনাস্ত নামের নামকরা জার্নালে। সেখান থেকেই রাসতোৎস্কি তুলে নেন উপন্যাসটি, তৈরি করান চিত্রনাট্য।
ফিদোত ভাস্কোভ একজন সেনা গোয়েন্দা। কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারেলিয়ায়। সেখানে কয়েকটি মেয়ে যোদ্ধার অধিনায়ক সে। এদের মধ্যে সদ্য স্কুল–পাশ করা মেয়েরাও রয়েছে। মেয়েদের একজন হঠাৎ দুই নাৎসী সৈনিককে দেখে ফেলে। তখন হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠানো হয়। নির্দেশ আসে, ‘নিকেশ করে দাও।’ ওরা ফাঁদ পাতে। দুই নাৎসী সৈনিককে ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হলেও হঠাৎ ওরা দেখে ১৬ জন ছত্রীসেনা সেখানে। এবার শুরু হয় সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। কী হয় শেষে, সেটা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। তবে এই ছবি দেখে রিতা, লিজা, ঝেনিয়া, গালিয়াদের জন্য আপনার মনে যে ভালোবাসা তৈরি হবে, সেটা আমি দৃঢ়ভাবে বলে দিতে পারি।
ছবিগুলো দেখলে মনে হবে, এক একটা যুদ্ধ নিঃস্ব করে দেয় সবকিছু, দুমড়ে মুচড়ে দেয় চারপাশ, কিন্তু তারই এক ফাঁক দিয়ে আবার উঁকি দেয় মানবতা। সেখানেই শান্তির বসবাস।