উত্তাল মার্চ | জাহীদ রেজা নূর

লেখাটি শেয়ার করুন

Share on facebook
Share on linkedin
Share on twitter
Share on email

জাহীদ রেজা নূর

বিক্ষোভ, সভা আর মিছিল

আমরা তো ভুলে যাইনি, ১লা মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে দিয়ে ইয়াহিয়া খান বারুদে আগুন দিয়েছিলেন। আজকের তরুণ বুঝতেও পারবে না সে সময়ের তরুণের হৃদস্পন্দন। নাকি পারবে? তারুণ্য তো সবসময়ই নতুনত্বের খোঁজে ছোটে। পুরনোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ১৯৬৬ সাল থেকে ৬ দফার ভিত্তিতে যে আন্দোলন চলছিল, সে আন্দোলনই পরিণত রূপ পেয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। সে সময়ের পূর্ব বাংলার মানুষ নিজেকে উজাড় করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। তাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যখন পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলেন, তখন ঢাকা শহর পরিণত হলো মিছিলের শহরে। ঢাকার বাইরেও পৌঁছে গেল সে বাণী। পুরো ভূখণ্ডই তখন মিছিলে মিছিলে নতুন দিনের অঙ্গীকারে ভাস্কর।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ মঙ্গলবার একটি বিবৃতি দেন। সেই বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন এবং যাতে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের মতো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেদিকে কড়া নজর রাখার জন্য আমি জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন, হরতালের সময় একদল সুযোগসন্ধানী মানুষ পরিবেশ নষ্ট করে। ঝোপ বুঝে কোপ মারে। জনগণের ওপর সওয়ার হয়ে অনিষ্ট করে। তাই এই সতর্কতা।

ঢাকায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। এই গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে আগুন জ্বালাবেন না। যদি জ্বালান, সে দাবানল থেকে আপনারাও রেহাই পাবেন না। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার দাবিতে জনসমুদ্রের প্রতিটি নদী একই মোহনায় এসে মিশেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন দেশ নিয়ে কী ভাবছেন, সেটা জানার জন্য উদগ্রীব দেশের মানুষ। তারও উত্তর দিলেন তিনি। জানালেন, ৭ মার্চ বিকাল দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে এক গণসমাবেশে তিনি ভাষণ দেবেন। ৩ মার্চকে তিনি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানালেন।

ঢাকায় হরতাল পালন করার সময় এক শ্রেণীর লোক রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট লুটতরাজে লিপ্ত হয়েছিল। এই দুর্বৃত্তের দল জিন্নাহ এভিনিউ (এখনকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউ), বায়তুল মোকাররম, নবাবপুর রোড, তোপখানা রোড, সদরঘাট এলাকায় কয়েকটি দোকানে হামলা চালিয়েছিল। 

২ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রেডিওতে ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারির কথা ঘোষণা করা হয়। তার পরেও শহরের বিভিন্ন এলাকায় জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

এদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আমানুল্লাহ নামে একটি ১৩-১৪ বছরের ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গভীর রাতে মারা যায়।  আরো কয়েকজন এদিন মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। সকাল ১১ টায় তেজগাঁও ফার্মগেটের কাছে প্রথম গুলিবর্ষণ করা হয় এবং তাতে ৫ জন আহত হয়। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে এদিন জনতার ঢল নামে। শেখ মুজিবুর রহমান সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বাংলার মাটিতে যেন বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা না বাঁধে। যদি এ ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে, আমি বুকে ব্যথা পাব‌।’

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ সভাপতি আসম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক

করাচি থেকে খবর আসে, পিপিপি চেয়ারম্যান জনাব ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যেতে তিনি সব সময় প্রস্তুত আছেন।’

এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ সভাপতি আসম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন বক্তৃতা করেন। বক্তারা জনগণকে শান্তি ও শৃঙ্খলা সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তারা জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট না করার এবং সমাজবিরোধী বা দুষ্কৃতিকারীগণ যাতে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পারে সেই সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বেলা তিনটায় বায়তুল মোকাররমের পাদদেশে পাকিস্তান জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান বক্তৃতা করেন। সভায় জাতীয় লীগ নেত্রী আমেনা বেগম বক্তৃতার শুরুতেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করে তার সমালোচনা শুরু করলে বিক্ষুব্ধ স্রোতারা প্রতিবাদে বিস্ফোরিত হয়ে ওঠেন। জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য আমেনা বেগমকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। জাতীয় লিগের অলি আহাদ গ্রুপ সমর্থক ফরওয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লকের পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাররমের সামনে আরো একটি গণসমাবেশ হয়।

পল্টন ময়দানে ন্যাপের উদ্যোগে আয়োজিত এক জনসভায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে ন্যাপনেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শ্রমিক নেতা সাইফুদ্দিন মানিক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি নুরুল ইসলাম প্রমূখ সভায় বক্তৃতা করেন।

থমথমে একটি দিন

সুসাহিত্যিক আবদুল হক তাঁর রোজনামচায় কী লিখেছিলেন ৩ মার্চ নিয়ে? সেদিকেই একটু চোখ রাখা যাক। ভুক্তিটির নাম দিয়েছেন তিনি ‘শেখ সাহেবের বিবৃতি’। লিখেছেন, ‘শেখ সাহেব এক বিবৃতিতে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। ৪, ৫, ৬ তারিখে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত সারা প্রদেশে হরতালের আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারী, বেসরকারী, আধা–সরকারী সব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্রতি এই আহ্বান, রেলওয়ে ও পিআইএসহ। রেডিও টিভি ও সংবাদপত্রের যদি আন্দোলনের সঠিক খবর প্রকাশ না করার চেষ্টা করা হয়,তাহলে তা প্রতিরোধের জন্য বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।’ আবদুল হক দেখেছিলেন, সব বয়সের মানুষ লাঠি ও লোহার রড হাতে নিয়ে চলাফেরা করছে।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রতিবাদে ঘোষিত কর্মসূচি পালনের দ্বিতীয় দিনে ৩ মার্চ ঢাকায় ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের উত্তাল সমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‌‌। ‘অবিলম্বে গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যান। যতদিন সেটা না হবে, ততদিন স্বাধীকারকামী বাংলার মানুষ আর সহযোগিতা করবে না। কোন কর খাজনা ও দেবে না।’— তিনি সামরিক সরকারকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলেন।

আবদুল হক যে কথাগুলো লিখেছেন, সেগুলোই ছাপা হয়েছিল পরদিনের পত্রিকায়। সে খবরগুলো থেকে জানা যায়, ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সভায় আওয়ামী লীগ প্রধান সর্বাত্বক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি নির্দেশ দেন। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত অফিস আদালতে যাওয়া বন্ধ, বেতার টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় প্রতি নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যদি আমাদের বক্তব্য বিবৃতি আমাদের আন্দোলনের খবরাখবর প্রকাশ প্রচারের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, সে নির্দেশ আপনারা লংঘন করুন।’ ভুট্টোগং-এর  উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র যদি না চান, আপনারা আপনাদের শাসনতন্ত্র রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই রচনা করব।’ এই কথার মধ্যেই দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাঙালির সকল আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। 

তেসরা মার্চের এই  সভাযটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আব্দুল কুদ্দুস মাখন-এর বক্তৃতার পর স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ পূর্বনির্ধারিত এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত প্রথম ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারটির মূল বিষয় ছিল জাতীয় সংগীত ঠিক করা, বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকার ঘোষণা দেওয়া।

কারা লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ করছে, কারা উচ্ছৃংখলা সৃষ্টি করছে, সেটা কারো অজানা নয়। এই কথা বলে শেখ মুজিব বলেন, ‘বাংলার স্বাধিকার বিরোধী বিশেষ মহল নিজেদের এজেন্টদের দ্বারা এসব অনাসৃষ্টি ঘটিয়ে যাচ্ছে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন বিপথগামী করার অশুভ চক্রান্ত রুখতে হবে।’

পরিস্থিতি যে ঘোলাটে হয়ে এসেছে, সেটা বুঝতে পারছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই পল্টন ময়দানের এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘হয়তো এটাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সে সুযোগ আমাকে নাও দেওয়া হতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলে যাচ্ছি, আমি যদি নাও থাকি, আন্দোলন যেন না থামে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন, তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকে, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। যে কোনো মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে।’

সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বাধিকার আন্দোলনের আহত সৈনিকদের দেখতে যান।

এদিন চট্টগ্রাম রংপুর ও সিলেট বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রংপুর আর সিলেটে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান আবদুর রাজ্জাক দুষ্কৃতকারীদের সকল প্ররোচনা ও উস্কানির মুখেও সংযত থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলার স্বাধীকার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী  স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।

২ ও ৩ মার্চ ঢাকায় ২৩ জন নিহত ও তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জনকে নিহত অবস্থায় মেডিকেল কলেজে আনা হয়। পত্রিকায় নিহতদের নাম ছাপা হয়।  নিহতদের মধ্যে আবুল কাশেম বুড়িগঙ্গায় ফেরীনৌকার মাঝি ছিলেন। কালিগঞ্জ চরঘাটে তাঁর নামে অন্যান্য মাঝিরা একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন।

এইদিন বেলা ২টা পর্যন্ত সারাদেশে হরতাল ছিল। কিন্তু সারাদিনই হরতাল পালিত হয়। বিকেল অল্প কিছু রিকশা বের হয়। পান সিগারেট ওষুধের দোকান, রেস্টুরেন্ট ও কাঁচাবাজার ছাড়া সব দোকানপাটই বন্ধ থাকে। ঢাকা থেকে কোনো ট্রেন ও পিআইএ বিমান ছাড়েনি।

সকালে গুলিবিদ্ধ মৃতদেহসহ শোভাযাত্রা বের হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শোভাযাত্রীরা শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। 

বেতার টিভিকে শিল্পীদের ‘না’

৪ মার্চ আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য বাংলার বীর জনতাকে অভিনন্দন জানান। তিনি মনে করিয়ে দেন, চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনদিন কোন জাতির মুক্তি অর্জিত হয়নি।

এই দিন করাচি প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল আজগর খান বলেন, দেশ বিপর্যয়ের একেবারে প্রান্ত সীমায় পৌঁছেছে। পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি।

২০ জন বিশিষ্ট বেতার টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রশিল্পী সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, যতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকবে এবং যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত তারা বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ছিলেন লায়লা আরজুমান্দ বানু ,আফসারী খানম, ফেরদৌসী রহমান, মোস্তফা জামান আব্বাসী, গোলাম মুস্তাফা, হাসান ইমাম, জাহিদুর রহিম, আলতাফ মাহমুদ, লায়লা হাসান, ওয়াহিদুল হক প্রমূখ।

ঢাকা ছিল বিক্ষোভের নগরী

পাকিস্তান পিপাস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো তার দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দুই দিনব্যাপী বৈঠক শেষে বলেন, দেশের সংহতির জন্য তার দল যতদূর সম্ভব ছয় দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জনৈক সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করেন, ছয় দফা মেনে নেওয়া এবং উভয় অঞ্চলের পৃথক হওয়া—এ দুটির মধ্যে কোনটিকে তিনি বেছে নেবেন? তখন ভুট্টো বলেন, দুটির মধ্যে কোন মৌল পার্থক্য আছে কি। অবশ্য অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য তিনি বলেন যে, পাকিস্তান পিপাস পার্টি ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতার শামিল বলে গণ্য করে না।

এদিন সকালে সিদ্ধেশ্বরী মোড়ে ডিআইটি আইল্যান্ডে শহীদ ফারুক ইকবালের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার বাবা আফসার উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি তার সন্তান ফারুক ইকবালকে হারিয়ে বাংলার সাত কোটি মানুষকে সন্তান হিসেবে পেয়েছেন।

বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের প্রতি ছাত্রলীগ ও ডাকসু এদিন সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানায়। সেই আহ্বানে বলা হয়, পাড়া, অঞ্চল, থানা, মহকুমা ও জেলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরে ছয়মাসের মধ্যে এবং সমগ্র বাংলাদেশে ৭ই মার্চের মধ্যে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কাজ শেষ করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত স্বাধীকার আন্দোলনে গুলিতে আহত মুমূর্ষ বীর সংগ্রামীদের প্রাণ রক্ষার্থে শতশত নারী পুরুষ ও ছাত্র-ছাত্রীর স্বেচ্ছায় রক্তদানের জন্য এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংকে যান। নারায়ণগঞ্জ থেকে ৩২ জন মাঝি ও রিক্সাওয়ালা রক্তদান করতে আসেন। কিন্তু তাদের কারো কারো ওজন ১১৫ পাউন্ডের কম হওয়ায় রক্ত দেওয়া সম্ভব হয়নি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ রক্তদান কার্যক্রমে অংশ নেন।

টঙ্গীতে গুলি

সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে এদিন টঙ্গীতে ৪ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। নিহতদের তিন জনের নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হলেন রফিজউদ্দিন,, আবদুল মতিন, আবদুল মিয়া।

ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে টঙ্গীর নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে এক বিরাট মিছিল বের হয় শহীদ মিনার থেকে। এস এম হল, আজিমপুর, নিউমার্কেট ও বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে আবার শহীদ মিনারে এসে শোক মিছিল শেষ হয়।

গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিল পথে-প্রান্তরে, আলোচনায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাকি বাংলা দেশে নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধের জন্য আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানিয়েছেন। বিদেশী একটি সংবাদ সংস্থার বরাতে ভারতের আকাশবাণী সংবাদটি প্রচার করেছিল। বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দেন। আকাশবাণী খবর প্রচার করে, শেখ মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ার করতে রাজি আছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, এ সংবাদ অসদুদ্দেশ্যমূলক ও কল্পনার ফানুস।

তখন পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশ শব্দটি লেখা হতো দুই ভাগে। বাংলা দেশ।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এইদিন ৫ মার্চ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং বাংলা দেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নীরিহ নিরস্ত্র মানুষ—শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের ধরাশায়ী করা হচ্ছে। অবিলম্বে এই নরহত্যা বন্ধ করতে হবে।’

গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিল পথে-প্রান্তরে, আলোচনায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাকি বাংলা দেশে নির্যাতন নিপীড়ন বন্ধের জন্য আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির অনুরোধ জানিয়েছেন। বিদেশী একটি সংবাদ সংস্থার বরাতে ভারতের আকাশবাণী সংবাদটি প্রচার করেছিল। বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দেন। আকাশবাণী খবর প্রচার করে, শেখ মুজিব ভুট্টোর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ার করতে রাজি আছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, এ সংবাদ অসদুদ্দেশ্যমূলক ও কল্পনার ফানুস।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে হরতালের চতুর্থ দিনে ঢাকায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতি হওয়ায় বৃহস্পতিবার সান্ধ্যআইন প্রত্যাহারের পর শুক্রবার সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সরকারি ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে সরকারি ছুটি ছিল রোববার। তাই শুক্রবারেও ঢাকাসহ সমগ্র বাংলা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। টঙ্গীতে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ছাড়া সারা দেশে বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। জুম্মার নামাজের সময় মসজিদে মসজিদে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত হয়।  

এইদিন ঢাকায় নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যেক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মিছিল করে রাজপথে নেমে আসেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে তারা এ দেশের আপামর মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্বাধীকার সংগ্রামের পথে অগ্রসর হওয়ার শপথ নেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান আহমদ শরীফ।

বেলা দুইটায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গন থেকে লাঠি মিছিল বের হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য রাফিয়া আখতার ডলির নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও লাঠি হাতে মিছিলে অংশ নেন। শহর প্রদক্ষিণ করে সবাই শহীদ মিনারে সমবেত হন। মিছিলের নেতৃত্ব দেন ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন।

মিছিল বের করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।  

২৫ মার্চ অধিবেশন আহ্বান

১ মার্চ জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এদিন দুপুরে তিনি জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এই দেশকে রক্ষার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোটি কোটি বাসিন্দার কাছে আমার দায়িত্ব রয়েছে। তারা আমার কাছে আশা করেন আমি তাদের হতাশ করব না। আমি কিছু সংখ্যক লোককে কোটি কোটি নিরীহ ও নিরপরাধ পাকিস্তানীর স্বদেশভূমিকে ধ্বংস করতে দেব না। পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ওপরন্যস্ত এবং এই দায়িত্ব প্রতিপালনে তারা কখনও ব্যর্থ হয়নি।’

তিনি ২৫ মার্চ  জাতীয় পরিষদের অধিবশন আহ্বান করেন।

প্রেসিডেন্টের ভাষণের কিছুক্ষণ পরেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও বাংলা দেশ শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এ ক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে। রাত পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা বৈঠকটি হওয়ার পর মুলতবি রাখা হয়। সভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদসহ ঢাকায় অবস্থানরত দলীয় ওয়ার্কিং কমিটির সকল সদস্যই যোগদান করেছিলেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর বিস্তারিত আলোচনা হয় কিন্তু এই ভাষণ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিক্রিয়া বা বৈঠকে দলীয় সিদ্ধান্ত জানতে পারেননি সাংবাদিকেরা।

কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) নুর খান লাহোরে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে।’

গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে দেখা করেন। প্রায় চল্লিশ মিনিট তাঁরা বৈঠক করেন। শনিবার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ব্যাংকসমুহ এবং যে সব বেসরকারি অফিসের কর্মচারীরা বেতন পাননি, সেগুলো খোলা থাকে।

বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে কয়েদীরা পালাতে গেলে পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদী নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। দরজা ভেঙে এবং পিছনের গেট টপকে তিনশোর বেশি কয়েদি পালিয়ে যায়।

এদিন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।

ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একশ্রেণীর দৃষ্কৃতকারী ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করছে। তিনি এ ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে সংগঠনের সম্পর্কহীনতার কথা জোর গলায় বলেন।

এদিন তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ও এমএনও তোফায়েল আহমদের নামে বিবৃতি ছাপা হয় ইত্তেফাকে। তিনি রেসকোর্স থেকে শেখ মুজিবের ভাষণ সরাসরি রেডিওতে রিলে করার দাবি জানান। মূলত সেটি নিজ দায়িত্বে  তৈরি করেন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন।

অস্থির মার্চ ৭ 
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ  ফারল্যান্ড  ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফারল্যান্ড তাকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষে না যাওয়ার পরামর্শ দেন।  বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, ‘পরিণতি যত ভয়াবহই হোক, আমি আমার জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে পারব না।’

দিনটি ছিল রোববার। স্বাধীকারকামী মানুষ একত্র হয়েছিল রেসকোর্সে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জনসমুদ্রের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, কন্ঠে ছিল স্লোগান। ‌বেলা দুইটায় সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আসেন ৩টা ১৫ মিনিটে। কিন্তু তাতে জনতার মধ্যে অসহিষ্ণুতা কিংবা অধৈর্য্যের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। বেলা ঠিক সোয়া তিনটায় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মুজিব কোট পরা বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এসে দাঁড়ালে জনতা করতালি ও স্লোগান দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল এক মহাকাব্য। ঢাকা বেতারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা সরাসরি প্রচার না করায় জনতার প্রচন্ড দাবির মুখে ঢাকা বেতারের কর্মরত সকল বাঙালি কর্মচারী বেতার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। বেতার কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর অর্থাৎ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বেতার ভবনে আঙিনায় একটি হাতবোমা নিক্ষিপ্ত হয়। 

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ঢাকা বেতার কর্মচারীদের কাজে যোগদানের জন্য আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ঢাকা বেতারে প্রচার করা না হলে তারা কাজে যোগ দেবেন না বলে জানিয়ে দেন।

ঐতিহাসিক জনসভার কিছুক্ষণ পরেই এক সাংবাদিক সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আজগর খান বলে, ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে হস্তান্তর করতে হবে এবং তিনি রাষ্ট্র কার্য পরিচালনার জন্য দেশের শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করার অধিকার আছে এবং আমি বুঝতে পারি না, কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা দেওয়া হবে না।’

পূর্ব পাকিস্তানের নবনিযুক্ত গভর্নর টিক্কা খান এদিন বিকেলে ঢাকায় এসে পৌঁছান। ‌‌

প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের জবাবে এদিন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিস্তারিত সে বিবৃতিতে অনেক কথাই তিনি বলেছেন, তবে কারা আওয়ামীলীগের কাছে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করেছে তাদের বিষয়টি তুলে ধরে বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বানচাল করার জন্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের সঙ্গে চক্রান্ত করতে থাকলে গণতন্ত্র কখনো প্রতিষ্ঠিত হয় না বা শাসন ক্ষমতাও জনসাধারণের কাছে হস্তান্তরিত হতে পারে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেশে আজ জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এই ক্ষমতার একমাত্র আইনানুগ উৎস। অন্য কোন ব্যক্তি এই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চাইতে অধিক ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না। আমরা বাংলাদেশের জনসাধারণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ মনে করি যে আমরাই বাংলাদেশের ক্ষমতার একমাত্র আইনানুগ উৎস। সংখ্যাগরিষ্ঠের দিক দিয়ে আমরা সমগ্র দেশের ক্ষমতার উৎসও বটে। গত সাত দিনের ঘটনাবলীতে দেখা গেছে যে, সমগ্র বাংলাদেশে কার্যরত সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের শাখাগুলি আমাদের আইনানুগ কর্তৃত্বের উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশ পালন করে চলেছে।’

এরকম একটা আশাবাদী তৈরি হয়েছিল যে ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। ছাত্র এবং যুবকদের মধ্যে এই ঘোষণার প্রতি দৃঢ় সমর্থন ছিল। স্বাধীনতাই হবে একমাত্র গ্রহণযোগ্য লক্ষ্য। ৭ মার্চে এ নিয়ে দলীয় সদস্যদের মধ্যে সন্দেহ ছিল সামান্য, কিন্তু একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণার অর্থ দাঁড়াবে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সর্বশক্তিতে সম্পৃক্ত করে ফেলা। ইয়াহিয়া খান তাঁর ভাষণে সেরকম একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নিরস্ত্র জনগণ এই আঘাত সহ্য করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে কিনা, এরকম শঙ্কা দেখা দেয়। শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের ইচ্ছা পূরণে সর্বাত্মক অশুভ শক্তি ব্যবহার করার সুযোগ নিতে পারে পাকিস্তান সরকার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে তা মোকাবিলা করলেন, সেটা এখন সবাই জানে। ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি স্বাধীনতা, মুক্তির সব নির্দেশ দিয়ে দিলেন, কিন্তু তাঁর কথা থেকে কোথাও তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেওয়া যাবে না।

৯ মার্চ 
মুজিবের পাশে দাঁড়ালেন ভাসানী

৯ মার্চ পল্টনে ন্যাপের বিশাল জনসভা হয়। সেখানে ন্যাপনেতা মওলানা ভাসানী বলেন, ‘শেখ মুজিবের নির্দেশিত ২৫শে মার্চের মধ্যে কোনো কিছু না করা হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল গণ আন্দোলন গড়ে তুলব।…প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলি, অনেক হয়েছে আর নয়। লা-কুম দ্বী’নুকুম ওলাইয়াদ্বীন (তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার) নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও।’ সভায় প্রস্তাব পাঠ করেন ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান।

সার্জেন্ট জহুরুল হক (ইকবাল) হল ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভা হয় সংগঠনের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে। সভার রাজনৈতিক প্রস্তাবে গত ২ মার্চ বটতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃত্বে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা দেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলা দেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। অপর এক প্রস্তাবে বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাংলা দেশে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য অনুরোধ করা হয়। সাংগঠনিক প্রস্তাবে আগামী কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের পরিবর্তে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ নাম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

ন্যাপপ্রধান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে এইদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টেলিফোন আলাপ হয়। পল্টন ময়দানে সভা করার আগে সন্তোষ থেকে ঢাকা আসার পরপরই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন।

৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের গণসমাবেশে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন, তা পুণঃপ্রচারের জন্য বাংলা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অসংখ্য টেলিগ্রাম ও টেলিফোন কল পাওয়া যাচ্ছে বলে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি জানান। তিনি ভাষণটি পুনরায় প্রচারের জন্য বেতার কর্তৃপক্ষ ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেন।

জাতিসংঘের মহাসচির উ থান্ট এ দিন প্রয়োজন হলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারবর্গকে অপসারণের জন্য ঢাকার জাতিসংঘের উপ আবাসিক প্রতিনিধিকে ক্ষমতা দান করেন।

পিআইএ-র ঢাকাস্থ বাঙালি কর্মচারীরা বিমানবন্দর থেকে মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গণদাবির সমর্থনে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাড়িতে আসেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন বলে তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে আশ্বাস দেন।

বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের এক বিবৃতিতে বলা হয়, তাদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় কেন্দ্রীয় তথ্য ও জাতীয় বিষয়ক দপ্তরের যুগ্মসচিব জহুরুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। বাংলা দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ যে শর্ত আরোপ করেছে, সে সম্পর্কে তারা যুগ্ম সচিবের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করেন। যুগ্ম সচিব যতদুর সম্ভব তাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। 

সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ রাজশাহীতে এইদিন রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্যআইন বলবত করে।

বাঙালি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়

১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন।  তিনি বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলা দেশের জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা।’ বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ-থান্ট বাংলা দেশ থেকে জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণের অনুমতি দিয়েছেন। সামরিক বাহিনীর লোকেরা বাংলা দেশে বসবাসরত বিদেশিদের জীবন ও ধনসম্পত্তি কতখানি বিপন্ন করে তুলেছেন, তা জাতিসংঘের জেনারেল সেক্রেটারির কার্যক্রমে তা বিবৃত হয়েছে। সেক্রেটারি জেনারেলের বোঝা উচিৎ, কেবল জাতিসংঘ কর্মচারীদের অপসারণ করলেই এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, যে হুমকি আজ উদ্যত হয়েছে, সে হুমকি গণহত্যার হুমকি। সে হুমকি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য জাতিসংঘ সনদের সংরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকৃতিরই নামান্তর।’

‘মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাসের অধিকার অর্জনের জন্য বাংলা দেশের আপামর মানুষ সর্বস্ব পণ করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ। ’

লন্ডন টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধি এদিন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে এলে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে। এবার বাঙালিরা এই রক্ত দেওয়ার পালা শেষ করতে চায়।’ বর্তমান গণবিক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সাড়ে সাতকোটি বাঙালি আজ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়।  এ ব্যাপারে তারা কোনো আপোস করতে রাজি নয়।’

স্বাধীন বাংলা দেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন যুক্ত বিবৃতিতে জানান,  ‘আমরা জানতে পারলাম, ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভয় দেখিয়ে, সংগ্রাম পরিষদের নাম ভাঙিয়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা হচ্ছে। কেউ এ রকম চেষ্টা করলে এ ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে জহুরুল হক হল (ইকবাল হল) খবর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। আমাদের আবেদন, কোনোা বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ, আইবি, সিআইডি যেন পাকিস্তান উপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করেন।’

নবনির্বাচিত এমএনএ এবং পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের (ওয়ালী গ্রুপ) সেক্রেটারি জেনারেল মীর গউস বখশ বেজেঞ্জো এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবগুলি দেশের বর্তমান পরিস্থিতেতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর প্রস্তাবগুলো শুধু পূর্ব পাকিস্তানই নয়, বরং সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।’

নিউইয়র্ক প্রবাসী পূর্ব পাকিস্তানি ছাত্ররা জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিক্ষোভকারীদের নেতা মি. আহমদ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এদিন ওয়ালী ন্যাপের উদ্যোগে শোষণমুক্ত স্বাধীন বাংলার দাবিতে নিউমার্কেট এলাকায় পথসভা অনুষ্ঠিত হয়।

শেখ মুজিবই দু অঞ্চলের মধ্যে যোগসূত্র

এইদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। কিন্তু সে বার্তায় ৭ মার্চ প্রেসিডেন্টের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  যে চারটি দাবি জানিয়েছিলেন সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ভুট্টো তার তারবার্তায় বলেন, ‘আমি অবিলম্বে পুনরায় ডাকা যেতে রাজি আছি এবং আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমস্যার একটি সাধারণ সমাধান উদ্ভাবনে প্রস্তুত আছি, যেন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য জাতীয় পরিষদের কাজ শুরু হতে পারে।’

কিন্তু এইদিন এক তারবার্তায় অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘অত্যন্ত দ্রুত সময়ে মধ্যে পট পরিবর্তন হচ্ছে। দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে যথাসম্ভব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ কুর্মিটোলার মার্শাল ল দপ্তরগুলো ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানী পতাকা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি বলে আজগর খান মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত, শেখ মুজিবের দেওয়া পূর্বশর্তগুলো মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কারণ, গত ২৩ বছর ধরে অপমানিত ও নিষ্পেষিত হওয়ার যে ধারণা বাঙালিদের মনে বাসা বেঁধেছে, তার ফলে এর বিন্দুমাত্র রদবদলে তাদের সন্তুষ্ট করা যাবে না। পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যকার ক্রমাগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানই সর্বশেষ যোগসূত্র। দেশের পূর্বাঞ্চল এখন একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে বসে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হলে মুজিবুর রহমানের পক্ষেও দেশের দুই অংশকে একত্রিত রাখা সম্ভব হবে না।’

এদিন পাঞ্জাব প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি এম খুরশিদ, ওয়ালী পন্থী প্রাদেশিক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করতে যান। 

টাঙ্গাইলে ন্যাপ প্রধান মৌলানা ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি সমর্থন দান করে সকলকে সাত কোটি বাঙালির নেতার নির্দেশ পালনের আহ্বান জানান। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এ দিন সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও পদক বর্জনের জন্য বাংলার জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 

পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব বি এ সিদ্দিকী প্রদেশের সাম্প্রতিক নিযুক্ত গভর্নরকে শপথ গ্রহণ করার অনুষ্ঠান পরিচালনা না করায় যে শাসনতান্ত্রিক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন ঢাকা হাইকোর্ট বারের ১৬ জন সদস্য তা অভিনন্দিত করেন।

জাতিসংঘের ঢাকায় নিযুক্ত উন্নয়ন কর্মসূচির ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি মি.কে উলফ এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এদিন জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘জোর করে কৃত্রিম সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হোন। রক্তপাত হানাহানির পথ পরিত্যাগ করুন।’

অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে।

ওয়ালি ন্যাপের পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাররম জিন্নাহ এভিনিউ, রথখোলা, বাহাদুর শাহ পার্ক প্রভৃতি এলাকায় পথসভা করা হয়। 

রেডিওতে অসত্য সংবাদ

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের নির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে বলে ১২ মার্চ ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স ডিরেক্টরেটের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী পাকিস্তান দিবসের খেতাব বিতরণ অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।

পিকিংপন্থী ন্যাপের সেক্রেটারি জেনারেল সি আর আসলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে যেসব পূর্ব শর্ত উত্থাপন করেছেন তা মেনে নিন।

প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট প্রেরিত ভুট্টোর তারবার্তাটি পরীক্ষাধীন থাকার খবরকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের নেতা জনাব খুরশিদ কর্তৃক শেখ সাহেবের জন্য প্রেসিডেন্টের একটি চিঠি বহন করে আনার সংবাদের সত্যতাও অস্বীকার করেন। রেডিওতে এই দুইটি অসত্য সংবাদ প্রচারে তিনি বিস্মিত হন।  বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে রেডিও মারফত দুটি অসত্য সংবাদ প্রচারিত হয়েছে।’ 

রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রের খ্যাতনামা বাংলা খবর পাঠক সরকার কবীর উদ্দিন রেডিও পাকিস্তান করাচি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান-সংক্রান্ত খবরের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার প্রতিবাদে রেডিও পাকিস্তান বর্জন করেন।

আগের কয়েক দিনের মতো এদিনও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খানকে সক্রিয় দেখা যায়। জনাব ভুট্টোর ২৮ ফেব্রুয়ারির বক্তৃতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দোষ করা হলো লাহোরে এবং বুলেট ঘোষিত হলো ঢাকায়, এটা ভাগ্যের পরিহাস। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র লোক যিনি এই সঙ্কট মুহূর্তে জাতীয় অখন্ডতা রক্ষা করতে পারেন।’

জাতীয় লীগ সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান এবং পাঞ্জাবের কামিলপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা পীর সাইফুদ্দিন পৃথক পৃথকভাবে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসায় সাক্ষাৎ করেন।

এদিন সকালে বগুড়া জেলার কয়েদিরা জেল ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে ১৫ জন কয়েদি আহত হয়। আহতদের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে। তবে ২৭ জন কয়েদি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় ।‌ এর আগে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ কুমিল্লা ও বরিশালেও জেল ভেঙে কয়েদিরা পালিয়ে গিয়েছিল।

এদিন রাতে বিবিসির খবরে বলা হয় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শনিবার করাচি থেকে ঢাকা পৌঁছবেন।

বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের এক সভায় স্বাধীকার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সুষ্ঠু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। অধ্যক্ষ সৈয়দ শফিকুল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঢাকার চারু ও কারু শিল্পীদের এক সভায় স্বাধিকার আন্দোলনে বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার উদ্দেশ্যে সাইক্লোস্টাইল করা দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী স্কেচ বিতরণ পোস্টার-ফেস্টুন প্রচার এবং পোস্টার ফেস্টুনসহ মিছিলের আয়োজন করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

ঢাকায় বোমা বিস্ফোরণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে দ্বিতীয় পর্যায়ে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ষষ্ঠ দিনে ১৩ মার্চ শনিবার ঢাকার সকল সরকারি আধা সরকারি অফিস-আদালত কর্মচারীদের অনুপস্থিতির কারণে বন্ধ থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যবসা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী খোলা থাকে এবং স্বাভাবিক নিয়মে কাজকর্ম চলে।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরে অত্যন্ত বিস্মিত ও মর্মাহত হলাম যে, বিগত কয়েকদিন ধরে যারা বাংলাদেশ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন, বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক লোক তাদের বাড়িঘর গাড়ি অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে অর্থপাচারে সাহায্য করছেন। তাদের মনে রাখা উচিত যে, স্বার্থান্বেষী মনোভাব গ্রহণ করে এমনিতর পুঁজি পাচার বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপন্থী। তাদের মনে রাখতে হবে যে বা যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের একটি পয়সাও বা সামান্য মূল্যের কোন জিনিসে আনতে দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আমরা আহবান জানাচ্ছি, তারা যেন কারো কাছ থেকে কোন জিনিসপত্র কিনে অর্থপাচারের মত এই সমাজ বিরোধী কাজের পরিসীমা বৃদ্ধি না করেন।’

জার্মান দূতাবাসের জনৈক মুখপাত্র একটি বার্তা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছেন যে, ৬০ জন পশ্চিম জার্মান, জাতিসংঘের ৪৫ জন কর্মচারী এবং ব্রিটিশ, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের প্রায় ৪০ জন নাগরিক এদিন বিকেলে ঢাকা থেকে ব্যাংককে যায়। জার্মান মুখপাত্র জানান, আজকের দলটি ব্যাংককে পৌঁছনোর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জার্মান নাগরিক অপসারণ সমাপ্ত হয়েছে।

রাত  আটটায় দিকে গভর্নর হাউস প্রাঙ্গণে একটি হাতবোমা বিস্ফোরিত হয়। সেদিন রাতেই ঢাকা ক্লাবের গেটের সামনে একটি হাতবোমা বিস্ফোরিত হয়।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান আব্দুল ওয়ালী খান বেলুচিস্তানের নেতা গাউস বক্স বেজেন্জোসহ এদিন করাচি থেকে বিমানযোগে ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের জানান, সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত দাবীর প্রশ্নে শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনি পূর্ণ একমত।

আগের দিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৩ মার্চ ঢাকায় আসবেন কিন্তু কখন আসবেন, আদৌ আসবেন কিনা এ প্রশ্নের জবাব ঢাকার কোন মহল দিতে পারেনি। ইত্তেফাকে প্রচারিত খবরে বলা হয়, বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রশাসনিক যন্ত্র বিকল হয়ে পড়েছে।…সমস্যা সমাধানের শেষ পথনির্দেশ বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই দিয়ে দিয়েছেন। স্বভাবতই দেশ-বিদেশের দৃষ্টি গিয়ে পড়েছে প্রেসিডেন্টের উপর। শুরুতে পশ্চিমাঞ্চলে ভুট্টোর ডাকে যে  হাঁকডাক শুরু হয়েছিল বাংলার মানুষের

 প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে তা স্তব্ধহয়ে গেছে।  পশ্চিমাঞ্চলের সম্বিৎ ফিরেছে।…

‘প্রেসিডেন্ট কি ঢাকায় এসেছেন?’

১৪ ই মার্চেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। তিনি বিবৃতিতে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে এ অবস্থায় কোন কোন অবিবেচক ব্যক্তি সামরিক আইন জারি করে বেসামরিক কর্মচারীদের একাংশকে দমিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু আজ ঐক্যবদ্ধ আপামর জনগণ সামরিক আইনের কাছে নতি স্বীকার না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।… বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে।…আমরা অজেয় কারণ আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। এবং প্রয়োজনে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররাও যেন স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীন ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

এইদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের ৩৫ দফা নির্দেশ জারি করেন। এই নতুন নির্দেশ জারির পর পুরনো নির্দেশগুলো বাতিল হয়ে যায়।

করাচির নিশতার পার্কের এক জনসভায় পিপিপি প্রধান ভুট্টো এক পাকিস্তানের দুই অঞ্চলে দুই দলের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানান।

এদিন সকালে ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাপ প্রধান খান আব্দুল ওয়ালী খানের সঙ্গে ৮৫ মিনিট ব্যাপী এক বৈঠক করেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং  ওয়ালী খানের সঙ্গে জনাব গাউস বক্স বেজেন্জো উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে একজন বিদেশী সাংবাদিক শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে রাজি আছেন?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘তিনি কি ঢাকায় এসেছেন?’ সাংবাদিক জবাব দেন, ‘না।’ শেখ মুজিব বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে কিভাবে দেখা হতে পারে? তবে প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এলে আমি তার সঙ্গে সাক্ষাতে রাজি আছি।’

মানব না এ বন্ধনে না মানব না এ শৃঙ্খলে

এদিন কেন্দ্রীয় স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচার বন্ধের জন্য সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঢাকার কয়েকটি স্থানে সোমবার থেকে চেকপোস্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিন ঢাকা ছিল মিছিল ও সভা সমাবেশের শহর রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন ছাত্র শ্রমিক কবি-সাহিত্যিক শিল্পী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন হয়।  

সংবাদপত্র প্রেস কর্মচারী ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত স্বাধীকারকামী প্রেস ওয়ার্কারদের একটি মিছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে। ইকবাল হল ক্যান্টিনে ঢাকা শহর ছাত্রলীগের আঞ্চলিক শাখাগুলোর সভাপতি ও সম্পাদকদের এক সভা শহর ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলে দ্বিতীয় রাজধানী এলাকায়, সন্ধ্যায় লালবাগ জগন্নাথ সাহা রোড বালুরঘাট মাঠে সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ শাখার উদ্যোগে পৃথক পৃথক জনসভার আয়োজন হয়। সকালে ডিআইটি ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত টেলিভিশন নাট্য শিল্পীদের এক সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলন প্রতি  একাত্মতা প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমিতে বিকেলে ডঃ আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে সভা হয়।

বিকেলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয় এক জনসভা।

মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক

ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠকটি শুরু হয় এই দিনে। মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে জাতির ভাগ্য নির্ধারণী আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা প্রায় আড়াই ঘন্টা প্রলম্বিত হয়। দীর্ঘ আলোচনা শেষে বাইরে আসার পর সমবেত সাংবাদিকরা শেখ মুজিবকে ঘিরে ধরে। শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, আগামীকাল ১৭ মার্চ সকাল দশটায় আবার বৈঠক হবে।’ 

ঢাকায় যে বৈঠক শুরু হয়, তাতে প্রেসিডেন্টের ঢাকার বাসভবনের শীর্ষে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়, অন্যদিকে জনগণের প্রদত্ত পার্লামেন্টারি ক্ষমতার অধিকারী শেখ মুজিবের গাড়ির সামনে বাংলার আপামর মানুষের শোকের প্রতীক কালো পতাকা পতপত করে উড়ছিল।

শেখ মুজিব উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে তার আলোচনা হয়েছে এবং আরো আলোচনা হবে। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। দুই-এক মিনিটের কাজ নয়। শেখ মুজিবুর রহমান যে কথা বলেছেন, তাতে আলোচনার গতিধারা সম্পর্কে কিছু আঁচ করা সম্ভব হয়নি সাংবাদিকদের পক্ষে।

সকাল ১১ টায় কড়া সামরিক প্রহরাধীন  প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে রুদ্ধদ্বার কক্ষে এই বৈঠকটি হয়।

প্রেসিডেন্ট ভবনে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু যখন বাসভবনের চত্বরে এসে উপস্থিত হন, তখন বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও কফটোসাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে। চারদিক থেকে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান।

সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেখ মুজিব বলেন, ‘এখন কিছু বলার নাই।’ এ কথা বলে তিনি তাঁর সাদা গাড়িতে উঠে বসেন।

প্রেসিডেন্ট হাউসে পোঁছুনোর পরও একদল সাংবাদিক তাঁকে ঘিরে ধরে। কিছুক্ষণ তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পর গাড়িটি প্রেসিডেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে। সাংবাদিকদের সঙ্গে একাকার হয়ে সেখানে তোফায়েল আহমদসহ কয়েকজন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যও অপেক্ষা করতে থাকেন।

আলোচনা চলাকালে দক্ষিণে কাকরাইল মসজিদ ও উত্তরে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের অদূরবর্তী চৌরাস্তার মোড় পার্যন্ত কড়া প্রহরা ছাউনি থাবায় সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ভবনের ধারে কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

বিকেলে পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক মিছিল বের করে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং মুর্তজা বশীর এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২ তম জন্মদিন ছিল এদিন। জন্মদিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালাই না। কেক কাটি না। এ দেশে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নাই।’ শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিন কী আর মৃত্যু দিবস কী? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।’

সকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সভায় ব্রতচারী আন্দোলনের স্থায়ী অনুশীলন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সভায় কলিম শরাফী সভাপতিত্ব করেন। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে গণমুখী কবিতা পাঠ এবং সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

‘আমার জন্মদিন কী আর মৃত্যুদিবস কী’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫২ তম জন্মদিন ছিল এদিন। জন্মদিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালাই না। কেক কাটি না। এ দেশে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নাই।’ শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিন কী আর মৃত্যু দিবস কী? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।’

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এইদিনের আলোচনা এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এসে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানান যে, আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি।

সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে এবং স্বীয় বাসভবনে দুইবার আলাপের পর শেখ মুজিবুর রহমান দুপুরের দিকে নিজের বাড়িতে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার গতিধারায় আলোকে আপনি কি হতাশ বা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন?— এই প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘হতাশা বা উৎসাহের প্রশ্ন ওঠে না। আমাদের আন্দোলন চলছে। জনগণ যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুদৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ আর ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ। সংকল্পবদ্ধ। গণশক্তিকে কেউই প্রতিরোধ করতে পারবে না।’ ‌

‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় আপনি কি সুখী না অসুখী, এই প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি তো বলেছি, নরকে বসেও আমার চিত্তে সুখের অভাব ঘটবে না, আমার চেয়ে বেশি সুখী আর কে আছে, সাত কোটি মানুষ আজ আমার পেছনে। পাহাড়ের মত অটল আমার জনগণ। আমাকে যা দিয়েছে তার কোন তুলনা নাই।’

একজন বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আপনার বাসভবনে আসার পরিবর্তে আপনি প্রেসিডেন্ট ভবনে গেলেন কেন? শেখ মুজিব জবাব দেন, ‘প্রেসিডেন্ট ভবনটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত আর বাংলাদেশের সব ঘরই আমার ঘর।’

নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি বিদেশি সাহায্যের প্রত্যাশী কিনা জানতে চাইলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘না আমার বিদেশি সাহায্যের দরকার নেই।’

এদিন বিক্ষুব্ধ ঢাকা নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সভা এবং শোভাযাত্রা হয়।

বিদেশি সাংবাদিকরা ডাকসু অফিসে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খান প্রেসিডেন্ট হাউসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস পালন উপলক্ষে বাংলা দেশের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী কৃষক শ্রমিকসহ প্রতিটি নর-নারীকে কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানান।

জনগণ আজ ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত

২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় কী পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের  সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনী

 তলব করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে তদন্তের জন্য খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এহেন তদন্ত কমিশন আমরা চাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। আমি দুঃখিত, যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমার উত্থাপিত দাবির পরিপূরক নয়। একটি সামরিক নির্দেশ বলে এই কমিশন গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে তার রিপোর্ট দাখিলের বিধান অত্যন্ত আপত্তিকর।

‘জনগণের পক্ষ থেকে আমরা গত ৭ মার্চ ৪ দফা দাবি তুলেছি। তার একটি দাবি ছিল, যথাযথ বিবেচ্য সূচিসহ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত অনুষ্ঠানের। ‌সেই দাবিগুলির নামমাত্র বা খন্ডিত স্বীকৃতে উল্লিখিত পদ্ধতিতে আমাদের সামনে বিরাজমান গভীর সংকট সমাধানে কিছুমাত্র সহায়ক হবে না।’ বিবৃতিতে এ কথা বলেন বঙ্গবন্ধু।

আওয়ামী পার্লামেন্টারি পার্টির ডেপুটি লিডার’ এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমাদের উপর্যুপরি প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপ বর্ধিত পরিমাণে অব্যাহত রয়েছে। … বারবার আমরা এইসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি কিন্তু তারপরও ক্যান্টনমেন্ট এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই ধরনের উস্কানিমূলক তৎপরতা অব্যাহত আছে। আমরা পরিষ্কারভাবে একথা জানিয়ে দিতে চাই যে, কোনরকম উস্কানিমূলক আচরণ তা যেকোন মহলেরই হোক না কেন তা সহ্য করা হবে না এবং উস্কানি দানকারীদেরকেই এর ফলাফলের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বহন করতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে মুক্তিকামী জনতার মিছিলের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরা দেখুন, আমার দেশের মানুষ আজ প্রতীক্ষায় কি অটল সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত। কার সাধ্য এদের রোখে? আমার দেশ আজ জেগেছে। জনগণ জেগেছে। জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য জীবন দানের অগ্নি শপথের দীপ্ত জাগ্রত জনতার এ জীবন জোয়ারকে, প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণকে স্তব্ধ করতে পারে এমন শক্তি মেশিনগানেরও আজ আর নেই।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।’

জয়দেবপুরে গুলি

১৯ মার্চ সেনাবাহিনী জয়দেবপুরে গুলি চালিয়েছিল। ঢাকা থেকে ২০ মাইল দূরে জয়দেবপুর ও তার আশপাশের এলাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে এদিন ২০ ব্যক্তির মৃত্যু হয় বলে বেসরকারিভাবে জানানো হয়। বহু লোক আহত হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা জানায়, এদিন বেলা আনুমানিক আড়াইটায় সেনাবাহিনীর কোন কোন কাজের প্রতিবাদে জয়দেবপুরে প্রায় ১০ হাজার লোক এক শোভাযাত্রা বের করে। তারা জয়দেবপুর রেল গেটের কাছে মালগাড়িসহ অন্যান্য ভারী জিনিসপত্র ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এই সময় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় লোকদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময় হয়। সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৪ বছরের নেয়ামত ও ৪০ বছর বয়সী মনু খলিফা নামে দুই ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয়দেবপুর সেনাবাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র নাগরিকদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করে বলেন, ‘যারা মনে করেন যে, বুলেট বা শক্তি প্রয়োগের দ্বারা গণ আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে, তারা আহম্মকের স্বর্গে বসবাস করছেন।’ 

ধানমন্ডির বাসভবনে সমবেত দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার করেছেন যে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা যদি সত্য হয়, তবে জয়দেবপুরের এক বাজারে গিয়ে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র নাগরিকদের উপর গুলি চালাল কিভাবে? ঢাকায় অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে আমি এই প্রশ্নের জবাব চাই।’

নিজের বাড়ির সামনে শোভাযাত্রা করে আসা সমবেত বিক্ষুব্ধ বিজ্ঞান কর্মচারীদের উদ্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীকার অর্জনের জন্য কোন কিছুকেই অসাধ্য বলে বিবেচনা করা হবে না। বাংলাদেশের রাজপথ অলিগলি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ আবার বাঙালির রক্তে জয়দেবপুরের মাটি সয়লাব হয়ে গেছে। আর কত রক্ত চাও, আর কত রক্ত পান করলে তোমাদের তৃষ্ণা মেটে? আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চাই। আর তোমরা চাও অস্ত্রের জোরে শক্তির জোরে শাসন করতে। কিন্তু বাঙ্গালীদের শক্তির জোরে দাবাইয়া রাখা যাবে না।’

ন্যপ প্রধান মাওলানা ভাসানী জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে শেখ মুজিবকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে আহ্বান জানান। দেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কে আলোচনার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা এদিন সন্ধ্যায় ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয় এবং তাতে উভয়পক্ষের তিনজন করে সদস্য যোগদান করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। প্রেসিডেন্টের পক্ষে ছিলেন এ আর কর্নেলিয়াস, লেফটেনেন্ট জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান।

এদিন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ভাষা আন্দোলনে কারাবরণকারী নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ নেতা খান সাহেব ওসমান আলী মারা যান।

পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন বলেন, ক্ষমতার ব্যাপারে তাদের হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে তিনি চুপ করে থাকবেন না। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টো-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নেন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকগণ।

ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা

২০ মার্চ প্রায় সোয়া ২ ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে। এদিন তাদের সঙ্গে ছিলেন তাদের সহকর্মীরা। প্রেসিডেন্ট ভবনের সামরিক বেষ্টনীর বাইরে বিপুলসংখ্যক জনতা বৈঠকের ফলাফলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। গত চার দিনের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হয়। এদিন শুক্রবারে জয়দেবপুরে সেনাবাহিনী ও জনতার সংঘর্ষের নয়া পরিপ্রেক্ষিত সম্ভবত অধিক সংখ্যক জনতাকে প্রেসিডেন্ট ভবনের কাছে টেনে এনেছিল। আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে এলে জনতা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা জানায়। এই সময় বঙ্গবন্ধুকে প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল।

 নিজ বাসভবনে ফিরে এসে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমাদের আলোচনা চলছে। আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।’ সোমবার আবার তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন বলে জানান।

বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আলোচনা চলছে। আমরা একটা সমাধানে পৌছাবার চেষ্টা করছি।’ ‘জয়দেবপুরের ঘটনার প্রতি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিনা এবং এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া কী’ প্রশ্ন করা হলে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট এদিকে দৃষ্টি দেবেন।’ আলোচনায় পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পৃথক পৃথকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। যদি দরকার হয়, পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে আমরা একত্রে বসে আলোচনা করতে পারি।’

এদিন বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। অপরদিকে আলোচনায় প্রেসিডেন্টকে সহায়তা করেন বিচারপতি কর্নেলিয়াস, জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান।

এদিনও ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। শোভাযাত্রা সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যারা যান, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনের কর্মচারী ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মচারী, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, প্রাদেশিক সরকারের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী এবং প্রাদেশিক সরকারের সেটেলমেন্ট কর্মচারীবৃন্দ।

জয়দেবপুরে এদিন সান্ধ্যআইন অব্যাহত থাকে। চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর বাজার ও ছায়াবীথি পর্যন্ত পুরো এলাকায় বিরামহীনভাবে এই সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকে। যার ফলে গরিব জনসাধারণের চরম অসুবিধা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঢাকাস্থ যে সকল আঞ্চলিক শাখা প্যারেড অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছে, সেই সকল শাখাকে রোববার বিকেল চারটায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী (লিয়াকত) হলে উপস্থিত থাকার নির্দেশ প্রদান করা হয়। ২৩ শে মার্চ প্রতিরোধ দিবসে সকাল ছয়টায় বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত ও বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার আহ্বান জানানো হয়।

এদিন পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মোহাম্মদ খান দৌলতানা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে 

দেখা করেন।

২১ মার্চ

২১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের এক অনির্ধারিত বৈঠক হয়। সকালে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক প্রায় ৭০ মিনিট স্থায়ী হয়। এ বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। আওয়ামী লীগ প্রধান এবং প্রেসিডেন্ট পরদিনও বৈঠক করবেন বলে ধারণা করা হয়।

একটানা ৪২ ঘন্টা কারফিউ অব্যাহত থাকার পর এদিন বেলা ১২ টায় জয়দেবপুর থেকে কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়। জয়দেবপুর এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়।

বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার বিভিন্ন কলেজ এবং স্কুল শিক্ষকদের সম্মিলিত সভায় বাংলাদেশ থেকে সকল পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণের এবং সে স্থানে বাঙালি সৈন্য নিয়োগ করার দাবি জানানো হয়।

বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব একে ব্রোহী এদিন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। ‌জনাব ব্রোহী তার আইনগত মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আগে প্রেসিডেন্ট জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রকারান্তরে এর পেছনে জনগণের অনুমোদন থাকবে। এছাড়া প্রয়োজনবোধে প্রেসিডেন্টের এই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা দিয়ে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক যথাসময়ে অনুমোদন করে নিতে পারবেন।’

সকালে ঢাকা পৌরসভার ভ্যাক্সিনেটর সমিতির উদ্যোগে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এক দীর্ঘ বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সভা অনুষ্ঠান এবং শপথ গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।  বিকেলে বাংলা একাডেমি লেখক শিবিরের উদ্যোগে এক গণমুখী কবিতা পাঠের আসর অনুষ্ঠিত হয়।

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অভিপ্রায় অনুসারে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন বিকেলে সদলবলে করাচি থেকে ঢাকা আসেন। সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের সময় তৃতীয় কোন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

এদিন আদমজীনগর খেলার মাঠে এক বিরাট শ্রমিক জনসভায় বক্তৃতা করেন ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে-আলম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘বাঙালিরা আর কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চায় না। মুক্তি ও স্বাধীনতার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বাঙালিরা তাদের প্রাণের দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।’

বিকেলে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনের সামনে সমবেত এক বিরাট জনতার উদ্দেশে ভাষণ দানকালে শেখ মুজিব বলেন, ‘বুলেট বেয়োনেট দিয়ে কখনো সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দাবিকে স্তব্ধ করা যাবে না।  শহীদদের রক্ত দান বৃথা যাবে না এবং জনগণের চূড়ান্ত বিজয় অবশ্যই হবে।’

খানিক আশার আলো

২২ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে ভুট্টো ছিলেন উপস্থিত। এ বৈঠক চলে ৭০ মিনিট। তাতে মনে হয় বরফ গলছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব ভুট্টো ‘আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন। চার দফা পূর্ব শর্ত পূরণ না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবে না বলে ঘোষণা করে। এ ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান যে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, তাতে ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো উভয়েই তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েছেন বলে অনুমান করা হয়। এই অনুমানের কারণ, সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরসহ বঙ্গবন্ধুর দাবি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠককালে এদিন প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।

প্রেসিডেন্ট ভবনের আশপাশে এদিন কড়া প্রহরা ছিল। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নির্ধারিত আলোচনা শেষে নিজ বাসভবনে ফিরে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কাছে আভাস দেন যে, আলোচনায় আরও অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে মিলিত হয়েছি। জনাব ভুট্টো সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট আমাকে জানান যে তার সঙ্গে আমার যেসব আলোচনা হয়েছে, তা তিনি ভুট্টো সাহেবকে অবহিত করেছেন এবং এ ব্যাপারে ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ করেছেন। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু মুহূর্তে বলতে চাই না।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের একুশতম দিবসে বিক্ষুব্ধ মানুষের সভা শোভাযাত্রা এবং গগনবিদারী ধ্বনিতে ঢাকা মহানগরী প্রকম্পিত থাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দিন রাজধানীর রাজপথে অবিচ্ছিন্ন মিছিলের স্রোত আর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ শপথের বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

সকালের দিকে স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং সিদ্ধিরগঞ্জের হকার কর্মচারীদের এক যৌথ মিছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। একটি দীর্ঘ মিছিলে ভুট্টোর কুশপুত্তলিকা বহন করা হয় এবং কুশপুত্তলিকাটি বিক্ষোভ মিছিলকারীগণ হাতের বর্শা দিয়ে আঘাত করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।

কচি-কাঁচার মেলার বিভিন্ন শাখা বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে। নীল টুপি পরিহিত লাঠিধারী কচিকাঁচাদের এই অপূর্ব মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শপথ গ্রহণ এবং দেশাত্মবোধক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ খ্রিস্টীয় পরিষদের এক সভায় বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। বিমান এবং স্থল বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মসূচিকে সর্বাত্মকভাবে সফল করে তোলার জন্য সোমবার শপথ গ্রহণ করেন। এদিন বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে আয়োজিত বিমান এবং স্থল বাহিনীর প্রাক্তন সৈনিকদের সম্মিলিত সমাবেশ থেকে বাংলাদেশের সকল অবসরপ্রাপ্ত সৈনিককে নিজ নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করে তোলার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়।

মিছিলের গন্তব্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি

২৪ মার্চ একের পর এক মিছিল আসতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ এই সব জঙ্গী মিছিলে শরিক হয়। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডি বাসভবনের সামনে আগত অগণিত মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ওপর কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে তা সহ্য করা হবে না। আমাদের ন্যায্য ও সুস্পষ্ট দাবি অবশ্যই মেনে নিতে হবে।’

শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষই আজ ঐক্যবদ্ধ এবং কোন শক্তি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই কিন্তু তারা যদি তা না চান এবং জনগণকে দাবিয়ে রাখতে চান, তাহলে তা পারবেন না। আশা করি তারা এই ভুল করবেন না। যে পর্যন্ত না বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুক্তি পাবে, দাবি আদায় হবে, সে পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। আপনারা শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যান।’

এদিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে পৌনে তিন ঘণ্টা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দিন আহমেদ রাতে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে ২ ঘন্টা ৪০ মিনিটব্যাপী এক বৈঠক শেষে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে ফিরে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করেন। তাজউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন কল্পে বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত চার দফা পূর্ব শর্ত পূরণের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট কতগুলো মূলনীতি মেনে নেন। আমরা তা কার্যকর করার বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করেছি। এ ব্যাপারে চূড়ান্তভাবে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করেছি। এবার এই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইলে প্রেসিডেন্টকে সুস্পষ্টভাবে তার বক্তব্য প্রকাশ করতে হবে।’

এক বিবৃতিতে তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, সৈয়দপুর চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য স্থানে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের যে সমস্ত খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি।

এদিন স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জাগ্রত দেশবাসীকে অভিনন্দন জানানো হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে বলেন, মঙ্গলবার সারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উত্তোলন করা হয়, ঠিক সে মুহূর্তে ঐদিন এবং আজ ঢাকা শহরের কোন এক এলাকায় এক শ্রেণীর লোক যেসব বাঙালি স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে সেইসব বাঙালির বাড়ি আক্রমণ করে, পতাকা ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে এবং বোমা নিক্ষেপ করা হয় বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। শুধু তাই নয়, গত মঙ্গলবার প্রতিরোধ দিবসে ঢাকার ফার্মগেট এয়ারপোর্টে নিরীহ জনগণকে মারধর ও নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। বিবৃতিতে প্রেসিডেন্টের ঢাকা অবস্থানকালে সেন্যবাহিনীর নির্যাতনমূলক কার্যকলাপের সমালোচনা করে বলা হয়, এধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে বাংলার জনগণ তথা মুক্তিকামী তার সমুচিত জবাব দেবে।

সে এক বীভৎস রাত!

জাহীদ রেজা নূর

২৫ মার্চ, ১৯৭১।

সেদিন পূর্ব পাকিস্তানিদের শায়েস্তা করতে চেয়েছিল ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী। রাস্তায় নেমে এসেছিল ট্যাংক আর অগণিত সেনাসদস্য। উদ্দেশ্য ছিল, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে। বাঙালি যেন আর কোনোদিন স্বাধীকারের দাবিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, বাঙালি যেন আর কখনো ক্ষমতার আসনে বসার কথা না ভাবতে পারে—এই ছিল ইয়াহিয়া-প্রশাসনের ভাবনা। জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে মিলে যে ষড়যন্ত্রের বীজ রোপন করেছিলেন ইয়াহিয়া, তারই নগ্ন প্রকাশ দেখা গেল এইদিন।

এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট।’

অপারেশন সার্চলাইট

অপারেশন সার্চলাইট

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছিলেন ইয়াহিয়া খান। কণনো দুপক্ষে ছিল তাদের উপদেষ্টারা। কখনো মনে হচ্ছিল বরফ গলছে, কখনো মনে হচ্ছিল, সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। খবর পাওয়া যাচ্ছিল, সোয়াত জাহাজ এসেছে অস্ত্র নিয়ে। যে কোনো সময় হামলা হতে পারে। ইয়াহিয়া কিন্তু একধরনের সমঝোতার আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছিলেন।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে অকস্মাৎ রাজপথে নেমে এল ট্যাংক, ভারি অস্ত্রবাহী ট্রাক আর কারবাইন হাতে পাকিস্তানি সেনারা।

ওরা হত্যাকাণ্ড চালালো রাজধানীজুড়ে। কয়েকটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুও ছিল তাদের।

পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, সংবাদপত্র অফিসের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দ্য পিপল। হিন্দুবসতীগুলো, বিশেষ করে পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, শাখারীবাজার এলাকা। ছাত্রদের বসবাসের স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল। শিক্ষকদেরও চিহ্নিত করে হত্যা করেছে তারা।

এই অপারেশন সার্চলাইটে যে বিন্দুমাত্র নৈতিকতার স্থান ছিল না, তা বোঝা যাবে তাদের নির্দেশনামার দিকে চোখ দিলে। সেখানে লেখা আছে ‘যেহেতু সেনাবাহিনীর মধ্যকার পূর্ব পাকিস্তানীয়দের মধ্যেও আওয়ামী লীগের ব্যপক প্রভাব আছে, তাই অপারেশন সূচনা করতে হবে অত্যন্ত ধূর্ততা (কানিংনেস), আকস্মিকতা (সারপ্রাইজ), ধোঁকাবাজি (ডিসেপশন) এবং দ্রুতগতির (স্পিড) সমন্বয়ে। এই কাণ্ডের হোতারা সুপারিশ করেছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যেন শেখ মুজিবকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন আর এরই ফাঁকে তারা নেমে যাবে রাস্তায়, হত্যা করবে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গ্রেপ্তার করতে হবে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের। শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে। ধানমন্ডি আর পুরনো ঢাকা হবে বিশেষ আক্রমণের স্থান।

অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করেছিল দুটো কম্যান্ড। ঢাকা শহরের অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তার অধীনে ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবারের ৫৭ পদাতিক ব্রিগেড এই হত্যাকাণ্ড চালানোর কাজটি সম্পন্ন করে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা।

কবে এই বাঙালি নিধনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল?

এটা ঠিক, অপারেশন সার্চলাইট কোনো আকস্মিক সিদ্ধান্ত ছিল না। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের আলোচনা থেকে অনুমান করা যায়, ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক শেষে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর আমন্ত্রণে লারকানায় গিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান, হাঁস শিকার করতে। সেখানে প্রচুর মদ্যপান ও হাঁসের রোস্ট ভক্ষণ করতে করতেই কি বাঙালি নিধনের এই ষড়যন্ত্র করা হয়? অনেকে সেটাই সন্দেহ করেন। আর ২২ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন প্রদেশের কমান্ডারদের সঙ্গে যে সভা করেন, সেখানেও ‘অপারেশন ব্লিৎজ্‌’ নিয়ে কথাবার্তা হয়। সেখানেই সামরিক অভিযানের অনুমোদন দেওয়া হয়।

২৫ মার্চ প্রথম প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে। কিন্তু থ্রি নট থ্রি হাতে কতক্ষণ প্রতিরোধ করা যায়? ৮০০ পুলিশ সদস্যের মধ্যে দেড়শজন শহীদ হয়েছিলেন। ভোরের দিকে পাকিস্তানিরা প্রবেশ করল রাজারবাগে। চালালো তাদের নৃশংসতা। জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলে জমল লাশের স্তূপ। দাউ দাউ আগুন জ্বলল তিনটি পত্রিকা অফিসে, রাজারবাগে, পিলখানায়। পুড়ল নয়াবাজার, ঠাটারিবাজার। সুযোগ পেয়ে মোহাম্মদপুর আর মিরপুরের বিহারীরা জবাই করতে থাকল বাঙালিদের। পাকিস্তানিদের হাত থেকে পলায়নপর শিশু-নারী-বৃদ্ধরাও বাঁচেনি।

সে রাত বারোটা অতিক্রম করার পর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেন স্বাধীনতার ডাক।

জেনোসাইড ঘটিয়ে বাঙালিকে চিরকাল পদানত করে রাখার খায়েশ পূর্ণ হয়নি পশ্চিম পাকিস্তানিদের। বেদনার্ত বাংলার জনগণ বুকে কষ্ট ধরে রেখেই ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। পশ্চিম পাকিস্তান এখন শুধুই পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান সাহসী লাল-সবুজ পতাকা হাতে এখন বাংলাদেশ।    

সাবাস বাংলাদেশ

স্বপ্নের মতো এসেছিল দিনটি। একটি দিন, একটি ঘোষণা বদলে দিয়েছিল জাতির ইতিহাস। পৃথিবীর মানচিত্রে রক্তের অক্ষরে লেখা হয়েছিল একটি নাম—বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার ২৫ মার্চ রাতে তাদের খুনিবাহিনী নামিয়ে দিয়েছিল এই ভূখণ্ডে। ঢাকায় তাণ্ডব চালানো হচ্ছিল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে, ঢাকার বাইরের দানব ছিল খাদিম হোসেন রাজা। তাদের কাছে প্রয়োজন ছিল এ দেশের মাটি। প্রয়োজন ছিল না এদেশের মানুষ। তাই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন জানিয়ে দিল, অখণ্ড একটি দেশের অস্তিত্ব আর নেই। আর অপারেশন ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর ২৬ মার্চ গ্রেপ্তারের আগে প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে।

২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে যে স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ২৬ মার্চ ছিল তার সফল পরিণতি। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। সংগ্রামের এই পর্বে স্বাধীনতার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগ ভুলবার মতো নয়। সে সব দিনে মুক্তির আকাঙক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির শোষণ ও নিপীড়নের যোগ্য জবাব দিয়েছে এ জাতি।

একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল জনযুদ্ধ। আপমর জনসাধারণ এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে নানাভাবে। যে যেভাবে পেরেছে এগিয়ে এনেছে মুক্তির কালটি। সম্মিলিত জনসংঘ বুঝিয়ে দিয়েছে, একতা মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে।

যুদ্ধের সেইসব দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। কিন্তু অবাক করা বিষয়, এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক অবয়বকে স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল একে অপরের প্রতিশব্দ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম ২৫টি দিন মানুষ দুলেছে আশা-নিরাশার দোলাচলে। সে সময়ের পত্র-পত্রিকার দিকে খেয়াল করলেই দেখা যাবে কীভাবে ষড়যন্ত্রটি তৈরি করেছিল ইয়াহিয়া গং। একদিকে বৈঠকের নাটক, অন্যদিকে বিমানে করে সৈন্য নিয়ে আসা।

বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে। নইলে এই দেশের সরকার গঠিত হয় না। এই দেশের হৃদস্পন্দন হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ব্যক্তিত্বই গড়ে তুলেছিল পরবর্তী নেতৃত্ব। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামানরা দিক-নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন তাদের নেতাকে স্মরণে নিয়েই।

একটি মানচিত্র ও একটি পতাকা পাওয়ার পিছনে যে লক্ষ-কোটি মানুষের ত্যাগ রয়েছে, সে কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। এই মানুষেরাই নির্বাচন করেছে তাদের নেতৃত্ব। এই মানুষেরাই গড়ে তুলেছে ঐক্য। এই মানুষেরাই একযোগে দেখেছে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। গোটা পৃথিবী উপলব্ধি করেছে এই জাতির ত্যাগ এবং কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতোই শিকার করে নিয়েছে, ‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়গে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

আরও লেখা

ইতিহাস

উত্তাল মার্চ

জাহীদ রেজা নূর বিক্ষোভ, সভা আর মিছিল আমরা তো ভুলে যাইনি, ১লা মার্চ সংসদ অধিবেশন

ভাষা নিয়ে কথা
ইতিহাস

ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা কথা

জাহীদ রেজা নূর ভাষা ছাড়া কি মানুষ হয়? মানুষের সবচেয়ে জটিল সৃষ্টি হলো ভাষা। কোত্থেকে,

জাহিদ রেজা নূর । স্বপ্নের সারথি
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Scroll to Top